আস্তিক ও নাস্তিক্যবাদের দর্শন – সৈয়দ রনো (পর্ব-০৩)

আস্তিক ও নাস্তিক্যবাদের দর্শন

দর্শন তত্ত্বের ব্যাখ্যা : যেহেতু আস্তিক ও নাস্তিক্যবাদের দর্শন এ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়, কাজেই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়কে সহজ ও সাবলীল ভাবে উপস্থাপনের জন্য দর্শন সম্পর্কে ব্যাখ্যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আলোচনার প্রারম্ভেই দর্শন সম্পর্কে ধারণা পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। দর্শনের তাত্ত্বিকতাই আস্তিকতা ও নাস্তিকতা সম্পর্কে আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। এ গ্রন্থে বর্ণিত যুক্তিযুক্ত বিষয়ের অধিকাংশই বিভিন্ন গ্রন্থ হতে আহরিত। আমার ব্যক্তিগত মতের প্রতিফলন ঘটেছে যতসামান্য। সহায়ক গ্রন্থ তালিকা সমাপ্তিতে উল্লেখ করেছি।
দর্শন শব্দের অর্থ :
গ্রীক Philos এবং Sophia হতে দর্শন শব্দটি এসেছে। প্রাচীন ল্যাটিন বা গ্রীক শব্দ Philos এর অর্থ হলো ভালোবাসা, প্রেম, অনুরাগ, আকর্ষণ, প্রণয়, প্রেরণা, আসক্তি এবং ভালোলাগা ইত্যাদি। ইংরেজি পরিভাষায় Love বা interest ।

গ্রীক শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো শহড়ষিবফমব বা রিংফড়স যার আভিধানিক অর্থ হলো জ্ঞান, অভিজ্ঞতালদ্ধ, নৈপূন্যতাপূর্ন, জ্ঞাতব্য বিজ্ঞতা, জ্ঞানবিদ্যা বা প্রজ্ঞা বা সত্যতা, নির্ণয়।
কোনো কিছু চোখে দেখে বা কানে শুনে তাঁর স্বরূপ উদঘাটন বা সত্যের উপলব্ধি করাই হচ্ছে দর্শন। এ জগত সংসারের চিরন্তন সত্যের অনুসন্ধানই হলো দর্শন, যা এ বিষয় জগত সম্পর্কে শাশ্বত জ্ঞানের অনুসন্ধান করে। আলোচনার ব্যাখ্যা হলো চোখের সাথে হৃদয়ের উপলব্ধি জড়িত।

দর্শন সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতবাদ বর্ণনা করা হলো : দার্শনিক প্লেটো বলেছেনÑ ‘দর্শন বস্তুর শাশ্বত এবং প্রয়োজনীয় প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ নিবেদিত।’
দার্শনিক হারবারর্ট স্পেসারের আধুনিক মতোবাদ হলোÑ ‘পরিপূর্ণভাবে সমন্বিত জ্ঞানই হচ্ছে দর্শন।’
শিক্ষা দার্শনিক জন ডিউই বলেছেনÑ ‘ব্যাপকভাবে প্রয়োগ উপযোগী শিক্ষা মতবাদই হচ্ছে দর্শন নামে পরিচিত।’
দার্শনিক পিথাগোরাস বলেছেন, ‘শুধু জ্ঞানের প্রতি আসক্তিই নয়, বরং জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের মূল্য নিরূপণের সুনির্দিষ্ট যুক্তিই হলো দর্শন।’
দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, ‘কোনো সত্যের অনুসন্ধান বা জিজ্ঞাসার উত্তরে নিজেকে ব্যাপৃত রাখার নামই হলো দর্শন।’
দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেনÑ ‘দর্শন হলো মৌলিক নীতিমালা সম্পর্কিত বিজ্ঞান, যা সত্ত্বার স্বরূপ এবং স্বরূপের অন্তর্গত যেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা অনুসরণ করে।’

বিভিন্ন দার্শনিকের ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের প্রেক্ষিতে দর্শনের অর্থ হচ্ছেÑ ফিলসফি শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ। দর্শন মূলত সংস্কৃত শব্দ, যার পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে বস্তুর প্রকৃত সত্তা বা তত্ত্বদর্শন। কাজেই এ কথা বলা যায় যে, সত্যের প্রতি ভালোবাসা, প্রজ্ঞার প্রতি প্রেম বা অনুরাগ বা আসক্তি হলো দর্শন।

দর্শনের বিষয় বস্তু : দর্শনের প্রধান কাজ হলো জগৎ জীবন ও ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান, প্রভৃতির স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করা। ধর্মীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর কারণে মানব জ্ঞানের প্রাচীনতম শাখা হিসেবে দর্শন শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে। দর্শন থেকেই জ্ঞান বিস্তারের অন্যান্য শাখার জন্ম হয়।
আধুনিক সময়ে দর্শনের বিষয়বস্তু অনেক বৈচিত্র লাভ করেছে। যথাÑ
১। অধুবিদ্যা : যা প্রকৃতি, মন, ঈশ্বর এবং স্বত্ত্বা সম্পর্কে আলোচনা করে দর্শন।
২। নীতিবিদ্যা : যা মানুষের ভালো মন্দ, ন্যায়, অন্যায়, মূল্যবোধ ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে দর্শন।
৩। ধর্মতত্ত্ব : যা জগতের সকল মানুষের ধর্মীয় প্রভাব, ধর্মীয় চেতনা বিশ্বাস ও মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করে দর্শন।
৪। তত্ত্ববিদ্যা : অনেকই তত্ত্ববিদ্যাকে দর্শনের প্রাণস্পন্দন বলে থাকেন। বিশ্বজগতের প্রকৃত সত্ত্বা সম্পর্কীয় আলোচনাকেই
সাধারণত তত্ত্ববিদ্যা বলা হয়। Ontology শব্দটি গ্রীক শব্দ ontos এবং logos থেকে উদ্ভব। কাজেই
ontology এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সত্ত্বা সম্পর্কীয় বিজ্ঞান।
৫। মূল্যবিদ্যা বা মূল্য সম্পর্কীয় দর্শন। Axiology or philo sophy or values জগৎ ও জীবনের মূল্যাবধারণ করতে গিয়ে-
(ক) দর্শন মূল্য বা আদর্শ কী?
(খ) মূল্যের স্বরূপ কী?
(গ) সৃষ্টিকর্তা অথবা ঈশ্বরের স্বপক্ষে কোনো যুক্তি দেয়া
যায় কি?
(ঘ) জগতের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক নির্ণয়।
এ ছাড়াও আরো অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করে দর্শন।
৬। জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) দর্শন। মানবীয় জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে দর্শনের এ শাখা আলোচনা করে। যেমনÑ
(ক) মানুষের জ্ঞানের স্বরূপ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে।
(খ) জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে ঘটেছে?
(গ) বিষয় বস্তুর সীমা ও পরিসীমার কতটুকু নিয়ে আলোচনা করে।
(ঘ) জ্ঞানের বিশাল পরিধি দর্শনের আলোচ্য বিষয়বস্তু।
৭। বিশ্বতত্ত্ব : ইংরেজি শব্দ কসমোলজি শব্দটি গ্রীক শব্দ কসমস হতে উদ্ধৃত হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে সুশৃঙ্খল বিশ্বজগত।
(ক) এ শাখা রূপবিজ্ঞান বা জগত দর্শন নামে আখ্যায়িত।
(খ) বিশ্বজগৎ, দেশ, কাল, জড়, প্রাণ, বিশ্বজগতের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ অর্থাৎ সৃষ্টি, বিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে দর্শন শাখা আলোচনা করে।

দর্শনের স্বরূপ (Nature) : ১। তত্ত্বগত ভাবধারায় জগৎ জীবন সম্পর্কে সত্যের অনুরূপই হচ্ছে দর্শন। জগত জীবন সম্পর্কিত যাবতীয় মৌলিক সমস্যার যৌক্তিক সমাধানের চেষ্টা করে দর্শন।
২। প্রজ্ঞার আলোকে সব কিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে দর্শন।
৩। দর্শন পরমাদর্শের স্বরূপ নির্ণয় করে।
৪। চরম সত্যের তত্ত্বগত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে।
৫। দর্শন এবং বিজ্ঞান সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে সম্পর্কিত।
৬। প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করা হচ্ছে দর্শনের প্রধান কাজ।
৭। দর্শন মানব জ্ঞানের আদিপুরুষ, যাকে সকল জ্ঞানের জনক রূপে অভিহিত করা যায়।
৮। বিস্ময় হতেই দর্শনের সৃষ্টি।
৯। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানব মনে বিস্ময় এবং অনন্ত জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে দর্শন।
১০। দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি সামগ্রিক, ব্যাপক এবং সমন্বয়ী দর্শনের আলোচ্য বিষয় জগত ও জীবনের রহস্য কেন্দ্রিক।
১১। ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য ছিলো না এবং বর্তমানেও নেই।
উপরোক্ত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হয় যে, দর্শন ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত। ধর্মীয় শাস্ত্রের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, মূল্যবোধের মধ্য দিয়েই দর্শন তত্ত্বের উন্মেষ ঘটেছে। এ আলোচনা থেকে ধর্ম ও দর্শন একে অপরের সম্পূরক বলে প্রতিভাত হয়।

অন্যধারা/সাগর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here