নাস্তিক্যবাদ উস্কে দেয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের দায় ও দায়িত্ব :
গণতন্ত্র কুক্ষিগত করে পুঁজিবাদ (ক্যাপিটালিজম) ও বিশ্বময় ভয়ানক ভোগবাদী জীবনধারা ও জীবনবোধ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। পশ্চিমা প্রজন্মের বিশাল অংশ এখন বিশ্বাস করে ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক, দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে, মধ্যখানে তার বেজায় ফাঁক’। এ উক্তির পর ধর্ম, মহাপুরুষ ও ধর্মগ্রন্থের জায়গাও নেই, দরকারও নেই, স্রেফ আনন্দ করে গেলেই জীবন সার্থক । পশ্চিমা দেশগুলোর আইনও এ বিষয়কে সমর্থন করে। তারা ভাবে ‘একটাই জীবন তোমার, নিজ কর্মের দায়িত্ব নিয়ে অন্যের অধিকার খর্ব না করে বা অন্যকে কষ্ট না দিয়ে জীবন উপভোগ করে যাও’। এ ধারণাই হচ্ছে নাস্তিক্যবাদ।
এর মধ্যে নারী-পুরুষের অবাধ সংসর্গও অন্তর্ভুক্ত। যৌবন এক পরাক্রান্ত শক্তি। জীবনের ষড়রিপু, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য্যÑ তার প্রথমটাই হলো কাম যা মানুষকে প্রবলভাবে তাড়িত করে। পরস্পরের সম্মতি থাকলে সাবালক নরনারীর মিলন অবৈধ নয়Ñ পশ্চিমা দেশগুলোর এ আইনের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে প্রজন্ম। ধর্মীয় মূল্যবোধ বিয়ের বাইরে দৈহিক সংসর্গের বিরোধী এবং পশ্চিমা প্রজন্মের অবাধ যৌনতায় বড় বাধা। এই আইনি অধিকার পশ্চিমা প্রজন্ম পেয়েছে সেটা আঁকড়ে ধরে আছে। দরকার হলে ধর্ম ছেড়ে দিয়ে নাস্তিক্যবাদের আশ্রয় নিচ্ছে, এ প্রবণতাও লক্ষনীয়। পশ্চিমা প্রজন্মের এ প্রবণতা আমাদের দেশগুলোতেও বাড়ছে।
‘ম্যান ডাজ নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন’। জীবনের স্রোত প্রয়োজনের তাড়নায় প্রবাহিত হয়। খাদ্যের পাশাপাশি মানুষের আধ্যাত্মিক চাহিদাও আছে, যেখানে ধর্মবিশ্বাসের বিকল্প নেই। এই আধ্যাত্মিক প্রয়োজনটাই হারিয়েছে এ প্রজন্মের বিশাল অংশ। এখন তাদের প্রয়োজন প্রধানত পার্থিব, অর্থাৎ দুনিয়াদারি। তাদের চাই টেকনোলজির সর্বশেষ সংস্করণ, চাই পার্টি, নতুন মডেলের গাড়ি, বাড়ি, আরও ভালো চাকরি বা নিজের ব্যবসা। তারা চায় দেশে দেশে ভ্রমণ করতে ইত্যাদি।
ধর্মই নৈতিকতার ভিত্তি। এ দাবিও অসার প্রমাণিত করার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে। কারণ, ধর্মহীন বা ধর্মে উদাসীন অথচ প্রবলভাবে আধ্যাত্মিক, উদার ও মানবিক গুণাবলীতে আলোকিত মানুষের অজস্র উদাহরণ চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। তারা কারও ক্ষতি করেন না ও বিপদে-আপদে সর্বশক্তি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান। হিন্দু সমাজে বিধবা-বিবাহ প্রতিষ্ঠার নায়ক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র কিংবা আফ্রিকাতে প্রধানত মুসলিম সমাজে ইসলামের নামে ভয়ংকর বর্বর প্রথা নারীর খৎনা উচ্ছেদে সর্বাত্মক চেষ্টাকারী রুডিজার নেহবার্গ দু’জনেই ধর্মহীন। দুর্ভাগ্যক্রমে, গির্জা, মন্দির ও মসজিদ-মাদ্রাসা ইত্যাদির অনেক ধর্মগুরুর ব্যক্তিগত হিংস্রতা, হানাহানি ও অশ্লীলতার খবরও প্রজন্ম জানতে পেরেছে। যেহেতু ধর্মগুরুদের ভাবমূর্তির উপর ধর্মের ভাবমূর্তি অনেকটাই নির্ভর করে, তাই এটাও ধর্মের প্রতি প্রজন্মের বিতৃৃষ্ণার বড় কারণ।
এসব জৈবিক চাহিদা মেটাতে ধর্মের সায় পাচ্ছে না বলেই নাস্তিকতার উদ্ভব ঘটেছে বলে পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ মনে করে। বুঝতে চায়না ওটা ধর্মের কাজই নয়। ধর্মের কাজ হেদায়েত করা এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, যার ধারও ধারছে না এ প্রজন্মের বিশাল অংশ। যা প্রয়োজন মেটাতে পারে না তা প্রাকৃতিক নিয়মেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে ও শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়। প্রজন্মের বিশাল অংশ ধর্মের মাধুর্য কী তা জানে না ধর্মের আবেদন তাদের কাছে নেই।
অভিজ্ঞতা কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না। পশ্চিমা প্রজন্ম সম্প্রতি দেখছে ধর্মের উৎস থেকে উঠে এসেছে ভয়াবহ গণহত্যা, গণধর্ষণ, ব্যাপক হিংস্রতা ও ধ্বংসযজ্ঞ। ইতিহাস ঘেঁটে তারা দেখেছে অন্য ধর্মের উৎস থেকেও অতীতে প্রবাহিত হয়েছে অগণিত নিরপরাধীর রক্ত ও অশ্রুস্রোত। হিংস্রতা, যুদ্ধ, রক্তক্ষয় অন্যান্য কারণেও হয় এবং তার ব্যাখ্যা সম্ভব। কিন্তু সেটা যখন স্রষ্টার নামে হয় তখন তা ব্যাখ্যার অতীত হয়ে দাঁড়ায়। প্রজন্ম জানেনা কোনো ধর্মই হিংস্রতা শেখায় না। জানে না যে ওগুলো ধর্মের অপব্যবহার মাত্র। কতিপয় শক্তিশালী ধর্মগুরুর হিংস্রতা মাত্র। তাদের অপকর্মের দায় গিয়ে পড়ে ধর্মের উপর। ইসলামের কথাই যদি বলিÑ কোরআনে আছে ব্যভিচার বর্জন করার নির্দেশ। ব্যাভিচারের শাস্তি আজীবন ঘরবন্দি অথবা আল্লাহ অন্য কোনো পথ নির্দেশ না করা পর্যন্ত, আছে ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে একশ করে চাবুক (বনি ইসরাইল-৩২, মুমতাহানা-১২, নিসা-১৫, নূর-২ ইত্যাদি)।
কিন্তু শরিয়াহ আইনে ব্যাভিচারের শাস্তি বিবাহিতদের মৃত্যুদণ্ড ও অবিবাহিতদের বেত্রাঘাত (হানাফি আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৭৮, বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড, ধারা ১২৯, পাকিস্তানের হুদুদ আইন ৭-১৯৭৯, অর্ডিন্যান্স ২০-১৯৮০ দ্বারা পরিবর্তিত, আইন নম্বর ৫ (২)-এর ‘অ’ ইত্যাদি)। বর্তমান সময়ে ধর্মীয় অনুশাসনকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করার মানসিকতা থেকেও নাস্তিক্যবাদ বিস্তার লাভ করেছে পশ্চিমা বিশ্বে।
পরিশেষে বলা যায়, পশ্চিমা বিশ্বের দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব মূল্যবোধে বিশ্বাসী হওয়া উচিত। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব সন্তান জন্ম দেবার পর পিতার পরিচয় নিয়ে বিব্রত বোধ করায় অনেক নারীই মাতৃত্ব হারাচ্ছেন, বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারছেন না। যুবক-যুবতীরা আনন্দে দিন অতিবাহিত করলেও বৃদ্ধ বয়সে এসে অসহায়ত্ব বোধ করছেন। পারিবারিক মায়া-মমতা নেই বললেই চলে।
তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে মানব জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণভাবে জীবন পরিচালনার জন্য অবশ্যই ধর্মের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ধর্মের প্রধান প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ হলো পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ চিরকাল ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এখনও ধর্মে বিশ্বাসী আছেন। ধর্ম ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। এটা খুবই সত্য যে: বিভিন্ন ধর্মেও ধর্মগুরুগণ ধর্ম প্রচার করেছেন। পাশাপাশি ধর্মীয় নীতিবাক্য প্রচার করেছেন অজস্র। আর তাতে কাজও হয়েছে যথেষ্ট। অসংখ্য নরনারী অসৎকাজ ত্যাগ করে সৎকাজে ব্রতী হয়েছেন এবং হচ্ছেনও। মূলত পশুবৃত্তি বা স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করে মানুষকে সুসভ্য, সৎ, ন্যায় নিষ্ঠাবান করে গড়ে তুলবার ব্যাপারে ধর্মীয় বিধান পালন করা অপরিহার্য। সুন্দর সমাজ ও জীবন গঠনের জন্য ধর্মগুরু বনাম ধর্মের বিধি নিষেধ এর গুরুত্ব অপরিসীম। (চলবে)
অন্যধারা/সাগর