কুরআন শরীফ এর আলোকে
যাবুর কিতাবে এ বর্ণিত আস্তিক্যবাদ : ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীদের মতে যাবুর একটি আসমানী কিতাব। মোট নাযিলকৃত (মতান্তরে কমবেশি) ১০৪টি আসমানী কিতাবের মধ্যে বড় ৪ খানা কিতাবের একটি হলো যাবুর। যাবুর হযরত দাউদ (আ:) এর উপরে নাযিল হয়েছিল। এটি হিব্রু ভাষায় লিখিত কিতাব। হযরত দাউদ -এর পুত্র হযরত সুলায়মান (আ:) -এর কালেও পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয় যাবুর। যাবুর কিতাব আস্তিক্যবাদের দলিল। রমজান মাসের ১২ তারিখে আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ:) -এর উপর আসমানি কিতাব ‘যাবুর’ নাজিল হয়। তার গোত্রের মাতৃৃভাষা ছিল ইউনানি, তাই ‘যাবুর’ ইউনানি বা আরামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হয়। মাতৃভাষায় ওহি নাজিল না করা হলে এগুলো অবতরণের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো। কারন আসমানি কিতাব অবতরণের মূল উদ্দেশ্য মানুষের হেদায়াতপ্রাপ্তি ও পূণ্য অর্জনের জন্য এর সঠিক মর্ম অনুধাবন করা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ঐশীগ্রন্থের আলোকে জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছেÑ ‘নিশ্চয়ই আমি তোমার কাছে ওহী প্রেরণ করেছি, যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীদের কাছে প্রেরণ করেছিলাম; ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণ; ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন ও সোলায়মানের কাছে ওহী প্রেরণ করেছিলাম এবং দাউদকে যাবুর দিয়েছিলাম’ (সূরা আন-নিসা)। অন্য আয়াতে বর্ণিত আছে, ‘আমি তো নবীদের কাউকে কারো ওপর মর্যাদা দিয়েছি এবং দাউদকে যাবুর দিয়েছি’ (সূরা বনি ইসরাইল)।
হযরত দাউদ (আ:) -এর পূর্বের একাদশ পুরুষ হযরত ইব্রাহিম (আ:) -এর দু’জন স্ত্রী ছিলেন। বিবি হাজেরার গর্ভজাত সন্তান হযরত ইসমাইল (আ:) -এর বংশধারায় পৃথিবীতে শুভাগমন করেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) [৫৭০-৬৩২ খ্রি.]; আর বিবি সারার গর্ভের সন্তান হযরত ইসহাক (আ:) -এর বংশধারায় হজরত দাউদ (আ:) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জালুত নামক অত্যাচারী রাজাকে ভীষণ যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করে এক বিশাল রাজত্ব লাভ করেন। যার রাজধানী ছিলো জেরুজালেম। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেÑ ‘দাউদ জালুতকে সংহার করার মতো, আল্লাহ তাকে কর্তৃত্ব এবং হিকমত দান করলেন। যা তিনি ইচ্ছা করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন’ (সূরা আল-বাকারা)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘স্মরণ করো, আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদের কথা, সে ছিলো অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী’ (সূরা সোয়াদ)।
হযরত দাউদ (আ.) নানাবিধ মানবিক গুণে ভূষিত ছিলেন। আল্লাহ তাকে সুমধুর কণ্ঠস্বর দান করেছিলেন। সুললিত ভাষায় তিনি ‘যাবুর’ তিলাওয়াত করতেন। তার পাঠ শুনে বনের পক্ষিকুল নেমে আসত এবং মনোযোগ সহকারে তা শুনতো। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘আমি তার রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাগ্মিতা’ (সূরা সোয়াদ)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই দাউদ ও সোলায়মানকে জ্ঞান দান করেছিলাম। তারা বলেছিলÑ ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের তার বহু মুমিন বান্দাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন’ (সূরা আন-নামল)।
আল্লাহ তাআলা হযরত দাউদ (আ:)-কে অনেক অলৌকিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। তিনি লোহা দিয়ে সুন্দর সুন্দর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বানাতেন। হযরত দাউদ (আ:)-এর পুত্র হযরত সোলায়মান (আ:) পিতার রাজত্ব আরও সুবিস্তৃত ও সমৃদ্ধশালী করেছিলেন। হযরত দাউদ (আ:) বায়তুল মোকাদ্দাসে তার আমলের রাজধানী স্থাপন করেন। একটি বিশাল ইবাদতখানা নির্মাণের কাজে হাত দেন। হযরত সোলায়মান (আ:) কর্তৃক জিনদের মাধ্যমে সেই কাজ সমাপ্ত হয়। এভাবে বায়তুল মোকাদ্দাসের পবিত্রতার মর্যাদা বাস্তবরূপ লাভ করে। হযরত ঈসা (আ:)-এর সময় থেকে তার অনুসারীদের স্বাক্ষর এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হয়। কুরআন মাজিদে বায়তুল মোকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন, তাতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাদপসরণ করো না, তাহলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে’ (সূরা আল-মায়িদা)।
হযরত দাউদ (আ:) ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। তিনি ছিলেন সুশাসক ও সুবিচারক। জনগণ সবসময় তার কাছ থেকে ন্যায়বিচার পেত। তার বিচারব্যবস্থা ছিলো নিখুঁত ও নিরপেক্ষ। তিনি রাজকোষ থেকে কোনো অর্থসম্পদ গ্রহণ করতেন না। তিনি যেমন ছিলেন ন্যায়পরায়ণ ও মানবদরদি, তেমনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং নিজের হাতে লৌহবর্ম তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি আল্লাহর কুদরতে লোহাকে নরম করে এর দ্বারা ইস্পাতের জেরা বা বর্ম তৈরি ও তা বাজারে বিক্রি করে যা আয় করতেন, তা দিয়ে সংসার চালাতেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ‘আমি নিশ্চয়ই দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং আদেশ করেছিলাম, ‘হে পর্বতমালা! তোমরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং বিহঙ্গকুলকেও; তার জন্য নমনীয় করে দিয়েছিলাম লৌহ, যাতে তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করতে পারো এবং বুননে পরিমাণ রক্ষা করতে পারো’ (সূরা সাবা)। উক্ত আলোচনাই হচ্ছে আস্তিকতার নিদর্শন।
নবী করিম (সা:) শ্রমের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে হযরত দাউদ (আ:) -এর স্বহস্তে উপার্জনের বিষয়টি উল্লেখ করে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন, ‘নিজের হাতের কাজ ও শ্রম দ্বারা উপার্জিত খাদ্য খাওয়া উত্তম, এর চেয়ে ভালো খাদ্য কেউ খেতে পারে না। হযরত দাউদ (আ:) নিজের হাতের শ্রমের উপার্জিত খাবার খেতেন’ (বুখারি)। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে ‘হযরত দাউদ (আ:) বর্ম তৈরি করতেন, হযরত আদম (আ:) কৃষিকাজ করতেন, হযরত নূহ (আ:) কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন, হযরত ইদ্রিস (আ:) সেলাইয়ের কাজ করতেন এবং হযরত মূসা (আ:) রাখালের কাজ করতেন’ (মুসতাদরাকে হাকিম)।
আসমানি কিতাব ‘যাবুর’ প্রাপ্ত আল্লাহর নবী হযরত দাউদ (আ:) -এর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হজরত দাউদ (আ:) -এর রোজা। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং এক দিন বিনা রোজায় থাকতেন’ (বুখারি ও মুসলিম)।
পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা মতে যাবুর কিতাবের বিশদ বর্ণনা রয়েছে। যাবুর কিতাব হযরত দাউদ (আ:) এর উপর নাযিল হয়েছিল। হযরত সুলায়মান (আ:) ও বংশ পরম্পরায় যাবুর কিতাবের আলোকে আল্লাহ তায়ালার মত ও পথের দাওয়াত দিয়েছেন। উল্লেখিত আসমানী কিতাবে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর হুকুম পালনের দৃষ্টান্ত স্পষ্ট লক্ষনীয়। কাজেই এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায়, আসমানী কিতাব যাবুর আস্তিক্যবাদের সুবিস্তীর্ণ বর্ণনার এক দালিলিক উপস্থাপন।
অন্যধারা/সাগর