ইঞ্জিল শরীফের আলোকে আস্তিক্যবাদ : ইঞ্জিল শরীফ একটি আসমানী কিতাব। এ কিতাব অবিকৃত অবস্থায় জীবন্ত খোদার কালাম। এ ধারণা যারা মনে প্রাণে পোষণ করেন তারাই আস্তিক। এই কালাম কমবেশী ১৯০০ বৎসর আগে নাযিল হয়েছিলো।
এই কিতাবের মাধ্যমে আল্লাহ ঈসা মসীহ্ইকে আদেশ নিষেধ ও সঠিক পথ দেখিয়েছেন। এতে তাঁর অসাধারণ জীবন, শিক্ষা, সুখবরের ক্ষমতা এবং মন্ডলী স্থাপনের কথা রহিয়াছে। এ কিতাবকে ২৭ টি খন্ডে বিভক্ত করা হয়েছিল। এর শেষ খন্ডে ঈসা মসীহ্র ভবিষ্যতে কী কী ঘটবে তা প্রকাশ করা হয়েছে।
‘ইঞ্জিল’ আরবী শব্দ। এর অর্থ সুখবর। এই বই আসল ইঞ্জিল শরীফের বাংলা অনুবাদ। এই অনুবাদে কোনো কঠিন শব্দ ব্যবহার করা হয় নাই। ফলে, শিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত সকলেই এর কথাগুলো বুঝতে পারবেন।
পাঠকের সুবিধার্থে প্রত্যেকটি খন্ডের আগে একটি করে ভূমিকা দেওয়া উচিত।
তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ও কুরআনসহ নবী ও রাসুলদের প্রতি নাযিলকৃত সকল আসমানী কিতাবকে ‘ওহী’ বলা হয়। সবই আল্লাহ তাআলার কালাম। ধর্মীয় ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণে একথা সুস্পষ্ট যে, কুরআন শরীফ ছাড়া অন্য সকল আসমানি কিতাব বিকৃত হয়ে বর্তমানে ভিন্ন রূপ লাভ করেছে। ফলশ্রুতিতে, সমাজে নাস্তিকতা জাঁকিয়ে বসতে পেরেছে। ধর্ম সম্পর্কে আমাদের ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। যাবুর কিতাবও বাইবেলের পুরানো নিয়মের ‘সামসঙ্গীত’ বা ‘গীতসংহিতা’ নয়; বরং আল্লাহ তা’আলা হযরত দাউদ (আ:) -এর
উপর যে কিতাব নাযিল করেছেন, তা হচ্ছে যবুর শরীফ। তেমনি আসমানি কিতাব ইঞ্জিল বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের নতুন নিয়ম কিংবা নতুন নিয়মের প্রথম চারটি কিতাব (মথি সুসমাচার, মার্ক সুসমাচার, লূক সুসমাচার ও যোহন সুসমাচার) নয়; বরং ইঞ্জিল সেই কিতাব, যা আল্লাহ তা’আলা হযরত ঈসা ইবনে মারইয়ামকে ওহীর মাধ্যমে দান করেছেন। ঈসা (আ:) সেটা বনী ইসরাঈলের মাঝে প্রচার করেছেন। মোদ্দাকথা, বাইবেলের পুরনো নিয়ম ও নতুন নিয়ম (প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফ)- এর কোনো গ্রন্থই ওহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত গ্রন্থ নয়। এগুলো পরবর্তীদের রচনা। আশ্চর্যের বিষয় হলোÑ রচনাগুলোর মূলকপিও খ্রিস্টানদের কাছে সংরক্ষিত নেই। এগুলোর রচয়িতা কে বা কারা, তাও নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। বাইবেল গ্রন্থগুলোর রচয়িতাদের ব্যাপারে খ্রিস্টানদের যেসব আলোচনা তাদের ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্বের কিতাবাদিতে পাওয়া যায় তার সবটুকুই অনুমান ও ধারণাভিত্তিক। এ বিষয়টা খোদ খ্রিস্টান পণ্ডিত ও গবেষকগণও স্বীকার করেন। প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফের লেখকগণ কেউ ঈসা (আ:)- এর হাওয়ারী ছিলেন না। তাছাড়া এ গ্রন্থগুলো যাদের বলে দাবি করা হয় তাদের পর্যন্তও কোনো ‘মুত্তাসিল সনদ’ বা অবিচ্ছিন্ন সূত্র খ্রিস্টানদের কাছে বিদ্যমান নেই।
আল্লাহ তা’আলা কুরআন মাজিদের মাধ্যমে তার বান্দাদের জানিয়েছেন যে, অন্যান্য কিতাবীরা আল্লাহ তা’আলার নাযিলকৃত কিতাবে বিকৃতি সাধন করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিকৃত অংশ আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের অংশ নয়। আর যতক্ষণ বিকৃত অংশ নির্দিষ্ট করা না হবে বিকৃতি-মিশ্রিত কিতাবের উপর বিশ্বাস করা জায়েজ হবে না। কিতাবীরা নিজেরা কিতাব রচনা করে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বলে প্রচার করেছে- এ কথাও আল্লাহ তা’আলা কুরআনের মাধ্যমে জানিয়েছেন। আফসোস! কিতাবীরা মূল তাওরাত, যাবুর ও ইঞ্জিল তো সংরক্ষণ করতে পারেনি, এমনকি এগুলোর বিকৃতিযুক্ত নুসখাগুলোও সংরক্ষণ করতে পারেনি। তাদের হাতে এখন যা আছে তা বাইবেল, ঐশীগ্রন্থ নয়। বাইবেল নামে তাদের কাছে যা রয়েছে, তাও কিন্তু আপন অবস্থায় নেই। তাতেও তারা পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধন করেছে। তারা বাইবেলে যে পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধন করেছে তাও শাব্দিক ও অর্থগত উভয় প্রকারেই হয়েছে। শাব্দিক বিকৃতির অর্থ হচ্ছে, শব্দের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন করা চাই তা এক শব্দের স্থলে অন্য শব্দ বসিয়ে হোক বা কোনো শব্দকে বিলুপ্ত করে কিংবা কোনো শব্দ বৃদ্ধি করে। আর অর্থগত বিকৃতির অর্থ হচ্ছে, শব্দের মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন না করে বাক্যের মূল অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাখ্যা করা। এই অর্থগত বিকৃতির বিষয়টি খ্রিস্টান পণ্ডিত ও গবেষকগণও স্বীকার করেন। তাদের মতে, পুরনো নিয়মের পুস্তকগুলোর যেসব পদে ঈসা (আ:)- এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে, ইহুদিরা সেগুলোতে অর্থগত বিকৃতি সাধন করেছে। এমনিভাবে প্রটেস্ট্যান্টগণ স্বীকার করেন যে, পোপের অনুসারীরা (ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা) বাইবেলের পুরনো ও নতুন উভয় নিয়মের বিভিন্ন পদের বিকৃত ব্যাখ্যা করেছে। পোপের অনুসারীরাও এই অভিযোগ প্রটেস্ট্যান্টদের দিকে আরোপ করেছে। সুতরাং বাইবেলের পুরনো ও নতুন নিয়মে অর্থগত বিকৃতির বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃত। বাকি রইলো বাইবেলের শাব্দিক বিকৃতি। বাইবেলে শাব্দিক বিকৃতিও হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। কখনো এক শব্দকে অন্য শব্দ দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছে। বাক্যের মধ্যে অতিরিক্ত শব্দ সংযোজন করা হয়েছে। বাক্য থেকে কিছু শব্দ বিয়োজন করা হয়েছে। কখনো আবার বাক্য বা বাক্যাংশকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। কখনো পুরো ঘটনাকেই সংযোজন কিংবা বিয়োজন করা হয়েছে। এসবই বাইবেল ও প্রচলিত ইঞ্জিলের শাব্দিক বিকৃতির বিভিন্ন রূপ। প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত ধর্মগ্রন্থের বিশুদ্ধতা ও সুত্র-বিষয়ক গবেষকগণ সঠিক ও সুদৃঢ় প্রমাণভিত্তিক দাবি করেছেন যে, ইহুদি-খ্রিস্টানগণ তাদের ধর্মগ্রন্থে শাব্দিক বিকৃতি সাধন করেছেন। অনেক আধুনিক খ্রিস্টান-অখ্রিস্টান গবেষকও শাব্দিক বিকৃতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। প্রচলিত ইঞ্জিল শরীফের কী অবস্থা! খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থ বলতে বিশেষভাবে বাইবেলের নতুন নিয়মের ২৭টি পুস্তিকার সমষ্টিকে বুঝানো হয়, যাকে বাংলায় ইঞ্জিল শরীফ ও নবসন্ধিও বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় নিউ টেস্টামেন্ট। আরবীতে আলআহ্দুল জাদীদ। আর বাইবেলের নতুন নিয়মের প্রথম চারটি পুস্তিকার প্রত্যেকটিকে বাংলায় সুসমাচার ও মঙ্গলসমাচার বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় গস্পেল। আরবী ও উর্দূতে বলা হয় ইঞ্জিল।
যেমন মথি সুসমাচার, মথি মঙ্গলসমাচার, গসপেল অফ ম্যাথিউ, ইঞ্জিলু মাত্তা, মাত্তা কি ইঞ্জিল ইত্যাদি। এ আলোচনা হতে বুঝা গেল ইঞ্জিল শব্দটি (আরবী ও উর্দূ যে ভাষাতেই ব্যবহার করা হোক) ইংরেজি গসপেল ও বাংলা সুসমাচার শব্দের সমার্থবোধক; নিউ টেস্টামেন্ট বা নতুন নিয়মের সমার্থক নয়। বাইবেলের নতুন নিয়মের পুস্তিকার সমষ্টিকে ইংরেজিতে নিউ টেস্টামেন্ট বলা হয় আর প্রথম চারটিকে বলা হয় গসপেলস। তেমনি নতুন নিয়মের পুস্তিকার সমষ্টিকে আরবীতে বলা হয় আলআহ্দুল জাদীদ আর প্রথম চারটিকে বলা হয় আনাজিল। নতুন নিয়মের পুস্তিকার সমষ্টিকে উর্দূতে বলা হয় আহাদ নামায়ে জাদীদ আর প্রথম চারটিকে বলা হয় আনাজিল। তবে বর্তমান বাংলাদেশের কিছু কিছু খ্রিস্টান সংগঠন নিউ টেস্টামেন্ট ও আলআহ্দুল জাদীদকে বাংলায় অনুবাদের ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। তবে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসই হচ্ছে আস্তিক্যবাদের দর্শন।
অন্যধারা/সাগর