একজন কন্ঠ জাদুকরের স্বপ্ন ।। রোদেলা নীলা

- Advertisement -
- Advertisement -

কিছু মানুষ আছেন যাদেরকে অনায়াসে শামুকের সাথে তুলনা করা যায়। শামুক যেমন নিজেকে একটা শক্ত খোলসের মধ্যে আটকে রাখে, সহজে বাইরে বের হতে চায় না: এই মানুষগুলোও তেমনি, নিজের কাজ আর চিন্তা নিয়ে নিবিষ্ট থাকেন আপন ভুবনে। নিজেকে জাহির করে বেড়ানোর আলাদা তাগিদ এদের মধ্যে কখনোই দেখা যায় না। আমি বলছি তেমন একজন প্রতিভাবান আবৃত্তি শিল্পীর কথা যিনি ইতোমধ্যে নিজের জাদুকরি কন্ঠের দ্বারা জয় করে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষের মন। তিনি আর কেউ নন, কথা বলছি বরেণ্য আবৃত্তিকার রাশেদ হাসানের সাথে।

একজন প্রিতিষ্ঠিত আবৃত্তিশিল্পী হতে গেলে কী পরিমান চর্চা করতে হয় তা তাঁর শোবার ঘরে চোখ বুলালেই বোঝা যায়। এটাকে ঠিক শোবার ঘর বললে ভুল বলা হবে, চারপাশে থরে থরে সাজানো আছে নানান লেখকের বই, আস্ত একটা লাইব্রেরী। বোঝাই যাচ্ছে, দিন বা রাতের বেশির ভাগ সময় তার বই পড়েই কাটে।

বইয়ের ভান্ডার থেকে চোখ সরিয়ে প্রশ্ন করি- আবৃত্তির প্রতি আগ্রহী হবার
কারণ কি? আদৌ এদেশে এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া সম্ভব কি?
বেশ আত্মবিশ্বাস ভরা কন্ঠেই উত্তর দিলেন-ছোটবেলা থেকেই এই

মাধ্যমের প্রতি এক ধরণের ভালোবাসা জন্মে গেছে, এরপর ধীরে ধীরে সমাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়ে গেছে। যেভাবে ছেলে মেয়েরা আবৃত্তিচর্চায় এগিয়ে আসছে তাতে করে এক সময় এটাকে পেশা হিসেবে নিতে চাইলে ভুল হবে না আশা করি। ১৯৯০ সালে গড়ে তুলেছি প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, বেশ সাড়া পেয়েছি। প্রতি বছরই বেশ বড় সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়। হয়তো শেষ অব্দি সবাই টিকে থাকতে পারেনা, ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে। কিন্তু শিল্পী হিসেবে যখন মঞ্চে দাঁড়িয়েছি তখন একটা বড় গোষ্টির ভালোবাসা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর সেই দায়বদ্ধতা থেকে নতুন শিল্পী গঠনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।

খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটা চলে আসে- অন্য সবাই যেখানে নিজেকে প্রচারে ব্যস্ত, সেখানে আপনি এতো গুটিয়ে রাখেন কেন নিজেকে?
খুব হেসেই উত্তর দিলেন- দেখুন, প্রচারের কাজ তো আমার নয়, ওটা মিডিয়ার দায়িত্ব। আমার কাজ আমি করে যাচ্ছি, যাদের প্রচারের দায়িত্ব তারাই করুক সেটা।

এই যে এতোক্ষণ ধরে কথা বলছি, চট্রগামে বেড়ে ওঠা ছেলের মুখে কোন রকম আঞ্চলিকতা নেই। আমার বিস্ময় ভেঙে দিলেন রাশেদ হাসান নিজেই-আমার জন্ম লালদিঘীতে ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে মা কখনোই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন না। মুলত : তার কাছ থেকেই এই অভ্যেস ছোট বে¬াল থেকে রপ্ত করেছি।

পুরো ছাব্বিশটা বছর আবৃত্তি শিল্পের সাথে তিনি যুক্ত। বাংলাদেশ আবৃত্তি শিল্পের বিকাশে তিনি নিজেকে সমর্পন করেছেন সম্পূর্নভাবে। আবৃত্তির সাংগঠনিক নেতৃত্ব, নির্মান, প্রশিক্ষণ ও পরিবেশনা নিয়ে দেশের সীমানা অতিক্রম করে নিজেকে নিয়ে গেছেন বিদেশের প্রাঙ্গণে। আবৃত্তি পরিবেশন করে মুগ্ধ করেছেন ইংল্যান্ডসহ ভারতের বেশ কয়েকটি অংগ রাজ্যে একাধিকবার।

স্বভাবতই যেটা জানতে ইচ্ছে করে-পাশের দেশ ভারতে শিল্পীরা তাদের কাজকে পেশা হিসেবে নিয়েছে, আমরা পারছিনা কেন?
বেশ বিশ্লেষণে গেলেন তিনি- তাদের সংস্কৃতি বিকাশের জায়গাটা অনেক বড়। এমন নয় যে তারা আমাদের চাইতে অধিক প্রতিভাবান, তবে তাদের মধ্যে সাধনার প্রবণতা বেশি। আমাদের দেশে আবৃত্তি দিয়ে একটি ছেলে বা মেয়ে কাজ আরম্ভ করলেও দেখা যায় পরবর্তিতে তারা সেই জায়গায় থাকেনা। কেউ চলে যাচ্ছে অভিনয়ে, কেউ বা উপস্থাপনা বা খবর পড়তে। আবার কেউ শুধুমাত্র শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার জন্য আবৃত্তি চর্চা করছে। তাছাড়াও রাতারাতি তারকা হয়ে যাবার একটা তাড়না আজকাল ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কাজ করছে। সব মিলিয়ে আমরা সঠিক জায়গাটায় যেতে পারছিনা, তবে আমি কিন্তু আশাহত নই।

আত্মবিশ্বাসী চোখ থেকে মুখ ঘুরিয়ে আর একবার দেখে নিলাম ঘরটা। চারপাশে কেবল ছেয়ে আছে বিভিন্ন সংঠনের পুরষ্কারের নিদর্শন। সাউন্ড ক্যাসেলের আয়োজনে লন্ডনে ব্র্যাডি আর্টস এন্ড কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় রাশেদ হাসানের প্রথম একক আবৃত্তি সন্ধ্যা (১৮ জানুয়ারি, ২০০৪)। এছাড়া দেশের বাইরে একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দারভাঙ্গা হলে মঞ্জুষ দাশগুপ্ত স্মৃতি সংসদের আয়োজনে সারা বাংলা আবৃত্তি অভিযান ২০০৬ উৎসবে (৩১ ডিসেম্বর, ২০০৬), বাচিক শিল্পী সংস্থা কবিতালোক-এর আমন্ত্রণে ভারতের আগরতলায় নজরুল কলাক্ষেত্রে (২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২), সুকান্ত একাডেমি মিলনায়তনে ‘কবিতার সঙ্গে গেরোস্থালি’ শীর্ষক আবৃত্তি সন্ধ্যায় (২৭ এপ্রিল ২০১৪), আগরতলা রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনে ‘‘অভিন্ন হৃদয়ে কবিতার ধ্বনি” শীর্ষক অনুষ্ঠানে (৩১ অক্টোবর ২০১৫), শ্রুতি আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ বাচিক উৎসবে আগরতলার রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনে (১১ আগস্ট ২০১৫), ভূবনেশ্বরী টেলিভিশনের আমন্ত্রণে আগরতলার রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনে (৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬), নাট্যমঞ্চের আমন্ত্রণে ভারতের ত্রিপুরার ধর্মনগরে বিবেকানন্দ সার্ধশত বার্ষিকী ভবনে (১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। নির্দেশনা দিয়েছেন ‘স্মৃতি-৭১’ ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, ‘কথা মানবীর ভাষ্য’, মানুষ জাগবে ফের’, ‘চট্টগ্রাম, বীর চট্টগ্রাম’ সহ বেশ কিছু আবৃত্তি প্রযোজনা।

রাশেদ হাসান আবৃত্তির নিরলস কর্মী। আবৃত্তিকে তিনি প্রসাধনপ্রিয় সৌখিন মাধ্যম হিসেবে দেখতে নারাজ। স্বপ্ন দেখেন শ্রেণীহীন, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। তিনি মনে করেন, ব্যক্তির চিন্তা ও সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে আবৃত্তিশিল্প অন্যতম সহায়ক শক্তি। এমন একজন স্বপ্ন জাগানিয়া প্রতিভাধর মানুষের কাছ থেকে ইতিবাচক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন শুনতে কে না চায়। আবৃত্তি কেবল রাশেদ হাসানের শখ নয়, এটা মানুষ গড়ার এক তীব্র হাতিয়ার।

- Advertisement -

আরো পড়ুুর