মোজাফফার বাবুঃ একজন মাষ্টার ইমান আলী গত ২৬ শে মে মহান ভাষা সৈনিক, বাম রাজনীতিবিদ. কৃষক আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ মাষ্টার ইমান আলী্র ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ,সামন্তবাদ বিরোধী এক অকুতোভয় সৈনিক। ১৯৩০ সালে ১ আগস্ট তিনি ঝিনাইদহ জেলার ( তৎকালীন বৃহত্তর যশোর জেলা) কালীগঞ্জ থানার মল্লিকপুর গ্রমে এক সম্ভ্রান্ত্ মুসলীম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ওয়ারেজ আলী একজন সমাজসেবক ছিলেন,মা আছিয়া খাতুন। ৭ ভাইয়ের মধ্যে ইমান আলী ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ভাইদের মধ্যে বড় ভাই ডাঃ লুতফর রহমান বিশ্বাস, মেঝো ভাই ছিলেন খেলাফত হোসেন, নওয়া ভাই এলাহি বিশ্বাস, অগ্রজ বেলায়েত হোসেন বৃটিশ বিরোধী রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন। তিনি তৎকালীন বৃটিশ ভারতে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন মুসলিম ছাত্রলীগের যশোর জেলার প্রতিষ্ঠাতা ছাত্র-নেতাদের অন্যতম। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষ করেন তার নিজ গ্রামের স্কুল মল্লিকপুর প্রথমিক বিদ্যালয় থেকে। পরে যশোর জিলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে যশোর মাইকেল মধুসূদন (এম.এম) কলেজে ভর্তি হন। তিনি ছাত্র জীবনেই বিপ্লবী রাজনীতিতে যোগ দেন এবং সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে এক গোপণ জরুরি বৈঠক হয়, সেখানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিম, প্রিন্সিপাল হাই, মাষ্টার ইমান আলীসহ ২৮ জেলার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। প্রতিনিধিবৃন্দ জানতে পারেন দেশ বিভক্তের কথা। সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার (বৃহত্তর) দাবী জানায় এবং শেষ রাত পর্যন্ত্ সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীন বাংলার জন্য দলিল তৈরি করা হয়। তারপর স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য চূড়ান্ত্ সিদ্ধান্ত্ গ্রহণ করা হয়। সবাই কলকাতাকে ৪ দিন বন্ধ রখার সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করে যার যার জেলায় ফিরে স্বাধীন বাংলার জন্য মুভমেন্ট শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলনের দিকে সবাই ঝুঁকে পড়ায় বৃহত্তর বাংলার আন্দোলন পিছিয়ে পড়ে। তবে গোপনে বৃহত্তর বাংলার আন্দোলন চলতে থাকে। তার কিছুকাল পর বাঙালির উপর আসে আর এক আঘাত। ভাষার অধিকার হরণের চক্রান্তে ফুঁসে ওঠে বাঙালি জাতি। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যশোর উত্তাল হয়ে ওঠে। মাইকেল মধুসূদন কলেজে গঠিত হয় ”রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। তিনি সেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসাবে ১৯৪৮ সালের ১১ এবং ১২ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট এবং ১৩ মার্চ হরতালের নেতৃত্বদেন ও ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের কারো মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ থাকলেও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট সফল ও মিছিল বের করার সিদ্ধান্তে অটল ছিলো। ১৩ মার্চে ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৮ সালে যশোরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে মাষ্টার ইমান আলী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে মাষ্টার ইমান আলী গণতান্ত্রিক পার্টিতে যোগদান করেন। গণতান্ত্রিক পার্টির বিলুপ্তিরপর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি (ন্যাপ)-এ যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে যশোরে কৃষক সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয় এ সভায় বক্তব্য রাখেন কমরেড আব্দুল হক, আব্দুল মালেক, মারুফ হোসেন প্রমুখ। এই সভা সফল করতে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮০ সালের ২৪ শে জানুয়ারী তিনি বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত্ তিনি এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির দায়ীত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সালের ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারী ৭ম জাতীয় সম্মেলনের মধ্যদিয়ে তিনি বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৮৮ সালে যশোর জেলার কেশবপুর-এ ডহুরী বাধঁ কাটার আন্দোলনে সক্রীয় নেতৃত্বে ভূমিকা পালন করেন। এ আন্দোলনে কৃষকনেতা গোবিন্দ দত্ত নিহত হন এবং সরোয়ার মাষ্টার, গোবিন্দ সরকারসহ অনেকেই আহত হন। ১৯৯০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর খুলনার বিল ডাকাতিয়া আন্দোলন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়িঘের বিরোধী আন্দোলন, ভৈরব নদ দখলমুক্ত করার আন্দোলন,১৯৯৩ সালে কৃষকদের ৭ দফা দাবিতে সংসদ ভবন ঘেরাও, ১৯৯৪ সালের সন্ত্রাস বিরোধী পদযাত্রাসহ যশোরে শ্রমিক-হোটেল শ্রমিক-দর্জি শ্রমিক- সুইপার আন্দোলন, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি এবং সাতক্ষীরাতে ভূমিহীন কৃষকদের খাস জমির দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারনীর ভূমিকা রাখেন। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি প্রথম যশোর কারবালা প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন, পরে খড়কী প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১০ই জানুয়ারি ১৯৭০ সালে তিনি ঘোপ মাহামুদুর রহমান হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৯০ সালের ৮ আগষ্ট পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। এ পেশায় তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালে হাইস্কুল শিক্ষকদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাকে ১ বছর কারাবরন করতে হয়। ১৯৫৯ সালের প্রথম থেকেই তিনি মাইকেল মধুসূদন (এম.এম) কলেজ প্রতিষ্ঠায় জমি সংগ্রহ ও ইমারত নির্মাণ প্রকল্প কমিটির সদস্য হিসাবে ভূমিকা রাখেন এবং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে স্বীকৃতিপান। যশোর সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠা, খুলনার পাইকগাছা থানার বেতকাশিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মাষ্টার ইমান আলী “বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষক ও কৃষির সমস্যাই মূলত : জাতীয় সমস্যা” এ বক্তব্যকে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন সংগঠিত করেন। আজীবন এ সংগ্রামী নেতা বিশ্বাস করতেন শোষণমূলক এ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়। তাই তিনি সকল প্রলোভনের হাতছানিকে উপেক্ষাকরে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে জনগণের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
লেখকঃ কবি মোজাফফার বাবু।
অন্যধারা/৬ জুলাই’২০/এসএএইচ