অন্যধারা ডেস্ক :
কক্সবাজারের নাজিরারটেক উপকূলে ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় চারটি বিষয়কে সামনে রেখে পুলিশের ৫টি দল একযোগে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। হত্যাযজ্ঞের মূল কারণ এখনও পুলিশের কাছে পরিষ্কার না হলেও এই ৪টির কোনো একটাই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম এমন ৪টি বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশের তদন্ত করা ৪টি বিষয় হচ্ছে, নিহতরা জলডাকাত হতে পারে, তাই ক্ষুব্ধ জেলেরা হত্যা করেছে। আবার, নিহতরা জেলে হতে পারে, ডাকাতরা তাদেরকে হত্যা করেছে। জল ডাকাতদের বিরোধের জের ধরে ২ পক্ষের সংঘর্ষে এই হত্যাযজ্ঞ হতে পারে বলে তদন্তে রেখেছে পুলিশ। সর্বশেষ যে কারণটি সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সেটি হলো, মিয়ানমার থেকে আসা মাদকের চালান লুট নিয়ে ঘটতে পারে এই হত্যাকাণ্ড।
৪টি কারণের মধ্যে সর্বশেষ কারণটির সূত্র ধরে এমন হত্যাযজ্ঞ বলে দাবি করেছেন মহেশখালী উপজেলার অধিকাংশ জেলে ও সাধারণ মানুষ। এর জন্য অনেকগুলো প্রশ্নও সামনে এসেছে।
ট্রলারের মালিক নিহত সামশু মাঝির পরিবার এ হত্যাকাণ্ডের জন্য আত্মীয় করিম সিকদারকে দায়ী করেছেন। আর সামশু মাঝির ট্রলারে থাকা মুসার নিখোঁজ নিয়েও রয়েছে রহস্য। মুসার সাথে করিম সিকদারের সখ্যতাও দেখেছেন স্থানীয়রা। জেলেদের দাবি, সামশু মাঝি ও নুরুল কবির এক সময়ের দুর্ধর্ষ ট্রলার ডাকাত হলেও সম্প্রতি সাগরে ডাকাতির কোনো তথ্য নেই। শামসুর বিরুদ্ধে ইয়াবা ও হত্যা মামলা পাওয়া গেছে মহেশখালী থানায়। আর নুর কবিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে। তাই তারা ডাকাতির পরিবর্তে মাদক বহনে সাগরে গিয়েছিলেন বলে দাবি করছে অনেকে।
শামসু ও নুরুল কবিরকে নিয়ে এলাকায় প্রচার রয়েছে, মহেশখালীর এক প্রভাবশালী পরিবারের মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা চালান বহন করে তারা। আর এই ইয়াবা পাচার করতে গিয়েই চালানো হয় হত্যাযজ্ঞ।
আত্মীয় হলেও করিম সিকদারকে কেন দায়ী করছে সামশু মাঝির পরিবার?
মামলায় নিহতদের পরিবারের পক্ষে কারণ উল্লেখ না করলেও এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করা হচ্ছে। এমনকি নিহত সামশু মাঝির স্ত্রী ও মা এ হত্যার পেছনে সরাসরি গ্রেপ্তারের পর পুলিশের রিমাণ্ডে থাকা করিম সিকদার মাঝিকেই দায়ী করছেন। অথচ সামশু মাঝি ও করিম সিকদার পরষ্পর আত্মীয়।
জানা গেছে, ট্রলার মালিক মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের হরিয়ারছড়া এলাকার ছনখোলা পাড়ার মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে সামশুল আলম প্রকাশ। সামশু মাঝির স্ত্রী রোকেয়া বেগম জানিয়েছেন, ৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় তার স্বামীর নেতৃত্বে ট্রলার যোগে সাগরে যান ১১ জন। স্বামীর সাথে ফোনে সর্বশেষ কথা বলেন ৯ এপ্রিল সকালে। এরপর আর যোগাযোগ করতে পারেননি। একই কথা বলেছেন নুর কবিরের স্ত্রীও।
তবে, ১১ এপ্রিল সাগর থেকে ফেরা ৬ জন এলাকায় ট্রলার ডাকাতির অভিযোগে ট্রলারের সকলকে হত্যার তথ্য জানিয়েছিলেন। তাদের দেওয়া তথ্য থেকেই মূলত জানাজানি হয় সাগরে জেলেদের হত্যার বিষয়টি।
মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বাদি সামশু মাঝির স্ত্রী রোকেয়া বেগম তার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তার স্বামীর ট্রলারের মাছ ও জাল লুট করার চেষ্টাকালে বাঁধা প্রদান করায় বাইট্টা কামাল, আনোয়ার হোসেন, বাবুল মাঝি ও করিম সিকদারের নেতৃত্বে ৫০/৬০ জন এ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
কিন্তু, করিম সিকদারসহ এজাহারে উল্লেখ থাকা মানুষের সঙ্গে তার স্বামীর বিরোধ কোথায় এমন প্রশ্ন করা হলে পরিষ্কার কোন উত্তর দেননি তিনি।
মহেশখালীর একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, সামশু মাঝি ও করিম সিকদার একে অপরের আত্মীয়। একই কথা বলেছেন সামশু মাঝির মা সোনা খাতুনও। তিনি জানিয়েছেন, করিম সিকদার তার বেয়াই।
এ হিসেবে সামশু মাঝি ও করিম সিকদার একে অপরের তালই। কিন্তু, ১১ এপ্রিল সাগর থেকে ফেরা ৬ জনের দেয়া তথ্যমতে, সাগরের ডাকাতিকালে সামশু মাঝিদের ট্রলারের হিমঘরে আটকে হত্যার ঘটনায় যে ৭ ট্রলার ছিল তার একটিতে ছিলেন এই করিম সিকদার।
১১ এপ্রিল সাগর থেকে ফিরে এ তথ্য দেয়া ৬ জন হলেন, মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের পূর্ব আঁধারঘোনা গ্রামের আব্দুস সালামের পুত্র মো. হায়াত, একই গ্রামের সালাহ আহমদের ছেলে আব্দুল মালেক ও মোহাম্মদ রিদুয়ান, দানু মিয়ার ছেলে আব্দুল মান্নান, আকবর আলীর ছেলে মাহবুব আলম, মো. শরীফের ছেলে নুরুস সামাদ, ছামিরাঘোনা এলাকার আবু জাফরের ছেলে নজরুল ও অফিস পাড়া এলাকার হেলাল উদ্দিন।
তারাই জানিয়েছিলেন, গভীর সাগরে ৯ এপ্রিল ফিশিং ট্রলারে ডাকাতি করার অভিযোগে মাতারবাড়ির এলাকার জনৈক বাইট্টা কামাল, বাইট্টা কামালের ভাই আমান উল্লাহ, একই এলাকার নুর হোসাইন বহদ্দারের মালিকানাধীন তিনটি ট্রলার, করিম সিকদার, আবছার মাঝি এবং বাবুল মাঝির ট্রলারসহ আরও ৭টি ফিশিং ট্রলার সামশু মাঝির ট্রলার ধাওয়া করে। এ সময় ট্রলারটি পানিতে ডুবিয়ে মাঝি-মাল্লাদের হিমঘরে আটকে দেয়া হয়।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, করিম সিকদার ও বাইট্টা কামালকে পুলিশের রিমাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সেখানে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে।
নিহত সামশু মাঝির ট্রলারের নিখোঁজ মুসা কোথায়?
এ ঘটনায় ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার এবং উদ্ধার কংকাল নিখোঁজদের একজন বলে পুলিশ ধারণা করলেও সামশু মাঝির ট্রলারে থাকা হোয়ানকের ছনখোলা এলাকার আলী আহমেদ হায়দাদের ছেলে মোহাম্মদ মুসা জীবিত না মৃত তার কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
মাতারবাড়ি, হোয়ানক, মোহরাকাটার কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ১০ মরদেহ উদ্ধারে থাকা সামশু মাঝি ও নুরুল কবির জেলেদের কাছে আতঙ্কের নাম। তাদের নাম ও চেহারার সাথে স্থানীয় জেলেরা পরিচিত। অত্যন্ত সাহসী এ ২ জন এক সময়ের দুর্ধর্ষ ট্রলার ডাকাত। কিন্তু, রহস্যজনক কারণে গত ২-৩ বছর ধরে তাদের নেতৃত্বে সাগরে ডাকাতি বন্ধ রাখে। তবে তারা ট্রলারে জেলে সেজে মাসে কয়েকবার সাগরে যান, আর ২-৩ দিন পর ফিরে আসেন। এদের সাথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অচেনা লোকজন থাকে। কিন্তু, সব সময় সাথে থাকেন মুসা। এলাকায় প্রচার রয়েছে, সামশু মাঝি ও নুরুল কবির মহেশখালীর এক প্রভাবশালী পরিবারের মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা চালান বহন করে থাকে। এরপর থেকে সামশু মাঝি ও নুরুল কবিরের জীবনের পরিবর্তন দেখা গেছে। বদলে গেছে ঘর, পোশাকসহ আর্থিক অবস্থাও।
৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় সাগরে গিয়ে না ফেরা সামশু মাঝিসহ ওই ট্রলারের ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ২৩ এপ্রিল। মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) মহেশখালী থেকে উদ্ধার হওয়া মানুষের কংকালটিও ট্রলারের নিখোঁজ জেলেদের একজন বলে ধারণা করছেন পুলিশ। তবে, ওই ট্রলারে থাকা মুসা প্রকৃত অর্থে কোথায় এ নিয়ে রয়েছে রহস্য।
জেলেদের দেয়া তথ্য মতে, এই মুসার সঙ্গে করিম সিকদারের গত মাস দুইয়ের এক সঙ্গে ঘোরা-ফেরা এবং আড্ডা দিতে দেখা গেছে। আর সামশু ও নুরুল কবিরের নেতৃত্বে ইয়াবার চালান আনার তথ্য করিম সিকদারকে জানিয়েছিলেন এই মুসা। যার সূত্র ধরে ইয়াবা লুটের পরিকল্পনা করেছিলেন করিম সিকদার। পরিকল্পনা মতে ৭ ট্রলার নিয়ে ইয়াবা লুটের পর অন্যান্যদের হত্যা করলেও মুসাকে নিজের ট্রলারে তুলে সরিয়ে রাখা হয়েছে।
হোয়ানকের ছনখোলা এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকে মুসার দেখা মেলেনি। তবে, পরিবারের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই নিখোঁজ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যাথা নেই।
মুসার শ্যালক আবদুল কাদের জানিয়েছেন, তার দুলাভাই হয়তো মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্যে রয়েছে। জীবিত থাকলে অবশ্যই ঈদের দিন ঘরে আসতেন।
তবে, রহস্যজনক বিষয় হচ্ছে মুসার কোনো খোঁজ না থাকলেও তার স্ত্রীর বিকাশ নম্বরে ঈদের আগে অজ্ঞাতভাবে টাকা এসেছে। বিষয়টি জানতে চাইলে আবদুল কাদের কোনো উত্তর দেননি। তিনি জানান, এটা তিনি জানেন না। বোনের সঙ্গে আলাপ করে বলতে পারবেন। সামশুর ট্রলারে মাঝি হিসেবে তিনি যতবার যান ততবার ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয় মুসাকে।
সামশু মাঝির স্ত্রী রোকেয়া বেগম জানিয়েছেন, মুসা তার স্বামীর ট্রলারের মূল মাঝি। যতবার সাগরে যান ট্রলারের সকলেই বাড়ি আসেন আর তিনি এক বেলা ভাত দেন। ৭ এপ্রিলও নুরুল কবির, মুসাসহ ১১ জনকে তিনি ভাত দিয়েছেন। এই ১১ জনই ট্রলারে গেছেন। আর বেশি ছিল না। তাদের সকলকেই হত্যা করা হয়েছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ট্রলারে প্রকৃতভাবে কতজন ছিল, এখনও কেউ নিখোঁজ আছে কিনা, বিষয়টি গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা হচ্ছে।
আত্মসমর্পণ করা সাগরের ডাকাতদের নাম যেভাবে শোনা যাচ্ছে:
২০১৮ সালে ৩ দফায় মহেশখালী, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, পেকুয়ার ১৭৩ জন সাগরের ডাকাত অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ২৩ এপ্রিল ১০ মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর নানাভাবে আলোচনায় আসছে আত্মসমর্পণ করা ডাকাতের অনেকের নাম। এর মধ্যে ১১ এপ্রিল সাগর থেকে ফিরে প্রথম সংবাদদাতা ৬ জনের মধ্যে একজন রয়েছেন যার পিতা আত্মসমর্পণকারীদের একজন। এ ৬ জনের মধ্যে রয়েছেন ছামিরাঘোনা এলাকার আবু জাফরের ছেলে নজরুল। আবু জাফরই আলোচিত ডাকাত ও আত্মসমর্পণকারী।
মহেশখালীর একাধিক লোকজন জানিয়েছেন, সাগরে সামশু মাঝির ট্রলারের হামলা করা ৭ ট্রলারে ছিলেন সোনাদিয়া এলাকার আলোচিত ডাকাত সুমন, মঞ্জুর ও মোনাফ। ৩ জনই আত্মসমর্পণকারী জল ডাকাত।
শুধু তাই নয়, গ্রেপ্তারের পর পুলিশের রিমাণ্ডে থাকা বাইট্টা কামাল বহুল আলোচিত সার পাচারকারীও। যার বিরুদ্ধে ২০ বছর আগে সার পাচারের মামলা হয়েছিল।
নানাভাবে নানা তথ্য পাচ্ছেন এবং গুরুত্বের সাথে তা তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম।
ঘটনার ডালপালা বাঁশখালী থেকে গহিরার দিকেও:
১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব। এর মধ্যে পুলিশ ৩ জনকে এবং র্যাব ২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের মধ্যে আদালতের আদেশে ২ আসামি ৫ দিন করে রিমাণ্ডে রয়েছে। অপর ৩ জনের মধ্যে বুধবার রাতে প্রযুক্তিগত সহায়তায় ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় চকরিয়া উপজেলার বদরখালী এলাকা থেকে গিয়াস উদ্দিন মুনির (৩২) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মুনির বদরখালী এলাকায় মো. নুর নবীর ছেলে। তাকে ইতোমধ্যে আদালতে পাঠিয়ে ৭ দিনের রিমাণ্ড আবেদন করা হয়েছে। রিমাণ্ড আবেদনের শুনানী হয়নি। বৃহস্পতিবার সকালে এ ঘটনায় সন্দেহজনক ২ জনকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে র্যাব।
এরা হলেন, বাঁশখালীর কুদুকখালী এলাকার মৃত সিরাজুল হকের ছেলে ফজল কাদের মাঝি (৩০) ও শামসুল আলমের ছেলে আবু তৈয়ব মাঝি (৩২)।
একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্য বলছে, এ ঘটনায় বাঁশখালীর ফজল কাদের মাঝি, আবু তৈয়ুব মাঝি ছাড়াও বাঁশখালীর নেজাম মাঝি ও শাহাব উদ্দিন মাঝি জড়িত রয়েছেন। ঘটনার সময় শাহাব উদ্দিন মাঝি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তিনি গোপনে কোথাও চিকিৎসা নিচ্ছেন। নেজাম মাঝি ও শাহাব উদ্দিন মাঝিকে গ্রেপ্তারে জোর তৎপরতাও চলছে। এ ঘটনায় সামশু মাঝির ট্রলার থেকে লুট হওয়া মালামাল গহিরা নিয়ে গিয়ে মজুদ করা হয়েছে। যেখানে গহিরার একটি চক্রও জড়িত। আর মুসা গহিরায় অবস্থান নিয়েছে বলে তথ্য রয়েছে।
আত্মসমর্পন করা জল ডাকাত সুমনের নাম যেভাবে এসেছে:
ট্রলারে নিহত ১০ জনের মধ্যে ৫ জন ছিলেন কিশোর, যারা কখনোই সাগরে যাননি। নিহত কিশোর ওসমানের মা জহুরা বেগম ও বোন জেসমিন আক্তার চ্যানেল ২৪ কে জানিয়েছিলেন, ওসমান গণি কখনো সাগরে মাছ ধরতে যাননি। মাঝেমধ্যে বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতেন। নুর কবিরের মাধ্যমে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে সাগরে চলে যায়। সাগরে যাওয়ার দুইদিন পর তারা বিষয়টি জানতে পারেন।
জহুরা বেগম আরও জানান, ওসমান গণির সাথে তার মেয়ে ইসমত আরার জামাই শওকত উল্লাহকেও নিয়ে যায়। শওকত উল্লাহও পেশায় জেলে ছিলেন না।
শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাছড়ির কয়েকজন জানান, গত ৭ এপ্রিল সাগরে যাওয়ার আগে ৫ এপ্রিল থেকে ওই এলাকার ৫ কিশোর দফায় দফায় বৈঠক করেন। এলাকার লোক হিসেবে কেউ বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখেনি। তাদের দাবি, নিহত কিশোরদের মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নুর কবির।
তাদের মতে, নিহত কিশোরদের যেহেতু মাছ ধরার অভিজ্ঞতা নেই, তাই তাদেরকে নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে সাগরে ট্রলার ডাকাতির জন্য অদক্ষ কিশোরদের নিয়ে যাবে না। তারা দাবি করেন, মিয়ানমার থেকে সাগর পথে মহেশখালী দ্বীপে আসা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে কয়েকটি ট্রলারে পাল্টানো হয়। তেমনটি একটি নির্দিষ্ট পথ পৌঁছে দেওয়ার জন্য নুর কবির আর শামসু মাঝিদের সাগরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে দাবি তাদের।
ওই ট্রলারে থাকা চকরিয়ার কোনাখালীর নিহত তারেকের বাবা জসিম উদ্দিন জানান, তার ছেলে রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। ওইদিনও কাজে গিয়েছিলেন। কিন্তু, একটি ফোন আসার পর কাজ ফেলে কাউকে কিছু না বলে চলে যায় তারেক। এরপর মর্গে মরদেহ পেয়েছেন তারা। সন্তান হত্যার বিচার চান তিনি।
সোনাদিয়ার একটি সূত্র বলছে, সোনাদিয়ার শীর্ষ জলডাকাত সুমন সাগরে ডাকাতির পরিবর্তে এখন মিয়ানমার থেকে সাগরপথে ইয়াবা পাচার করে যাচ্ছেন। প্রভাবশালী চক্রের আশ্রয়ে থেকে দিনে দিনে বেড়েছে তার মাদকের লেনদেন।
সূত্রটির মতে, শামসু মাঝি ও নুর কবিরের মাধ্যমে ৫ কিশোরসহ অন্যান্যদের ইয়াবা পাচারের জন্য সাগরে নিয়ে গিয়েছিলেন সুমন। নিহতদের মধ্যে চকরিয়ার কোনাখালীর সাইফুল ইসলাম পুতুর পরিবার সুমনের ফোনও পেয়েছিলেন ঘটনার পর। তবে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাইছেনা পুতুর পরিবার।
নুর কবির ও শামসু মাঝি ইয়াবার চালান নির্দিষ্ট স্থানে ডেলিভারি না দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সুমন ও তার অন্যান্য সহযোগীরা তাদের জিম্মি করে ইয়াবার চালান ছিনিয়ে নেয়। পরে অন্যান্য ট্রলারগুলোর মাঝিমাল্লাদের কাছে নুর কবির ও শামসুদের জলদস্যু আখ্যা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। ঘটনার পর থেকেই সুমন, মোনাফসহ অন্যান্যরা আত্মগোপনে চলে গেছে বলে জানা গেছে। সুমনের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার বন্ধ পাওয়া যায়।
ঘটনাটি সাগরের ডাকাত হত্যা বলে প্রচার করতে মরিয়া চক্রটি কারা?
১০ জনের মরদেহ উদ্ধারের পর সম্ভাব্য ৪টি কারণ সামনে রেখে পুলিশ তদন্তের কথা জানালেও বিষয়টি কি কারণে হয়েছে পরিষ্কার করেননি। এরপর গত ১১ এপ্রিলের পর থেকে সামশু মাঝির নেতৃত্বে ট্রলারে ডাকাতি করতে গিয়ে এদের হত্যার কথা নানাভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
যদিও কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, সাগরে সুনিদিষ্ট কোনো ট্রলারে ডাকাতির কোনো তথ্য পুলিশের কাছে কেউ জানাননি।
কিন্তু, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ডাকাতদের হত্যার কথা প্রচার হওয়ায় খুব বেশি বিব্রত হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন সামশু মাঝির স্ত্রী রোকেয়া বেগম। তিনি জানিয়েছেন, বাইট্টা কামাল, তার ভাই ও আত্মীয় স্বজন, করিম সিকদাররা মিলে তার স্বামীসহ সকলকে ডাকাত বলে প্রমাণ করতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। এর জন্য টাকাও বিনিয়োগের অভিযোগ করেন তিনি।
কারা এই টাকা বিনিয়োগ করছেন পরিষ্কার না করলেও রোকেয়া বেগম জানান, একটি প্রভাবশালী চক্র এতে জড়িত। তার স্বামী ডাকাত না। হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতেই এমন প্রচারণা।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘটনাটি নিয়ে মন্তব্য করা উচিত না। ডাকাতি না ভিন্ন কিছু এটা দেখছে পুলিশ।
রোববার (২৩ এপ্রিল) গুরা মিয়া নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধিন একটি ট্রলার সাগরে ভাসমান থাকা ট্রলারটি নাজিরারটেক উপকূলে নিয়ে আসে। আর ওই ট্রলারের হিমঘরে হাত-পা বাঁধা ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ইতোমধ্যে উদ্ধার হওয়া ৬ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করলেও মর্গে রয়ে গেছে ৪ জনের মরদেহ ও কংকালটি। ডিএনএ পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এ ৫ জনের পরিচয়।
খ.র