কবি নজরুলের এক মর্মগাথা প্রেমকথা । সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

কবি নজরুলের; এক মর্মগাথা প্রেমকথা 
সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

২৯ আগস্ট কবির ৪২তম মৃত্যুদিবস। প্রতি বছর বাংলাদেশ, ভারত ও প্রবাসে কবি নজরুলের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে থাকে। এবারও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হবে। কবির মৃত্যুদিবস উপলক্ষে আমার এই শ্রদ্ধাঞ্জলি। লেখাটি শেষ করবো কবির জীবনের একটি অপ্রকাশিত ঘটনা দিয়ে। আমার কলকাতার কবিবন্ধু শিশুসাহিত্যিক অমল ত্রিবেদী এটি লেখার জন্য অনুরোধ করেছেন। তিনিও এখন মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার জন্যও শুভকামনা রইলো। মূল ঘটনায় যাবার আগে কবি নজরুলের জন্ম ও ছেলেবেলা নিয়ে ছোট্ট একটু আলোকপাত করা যেতেই পারে।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন বিশ শতকের অন্যতম জনপ্রিয় অগ্রণী বাঙালি কবি। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক (ঔপন্যাসিক ও গল্পলেখক), গীতিকার ও শিল্পী, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং একজন সক্রিয় সৈনিক হিসেবে সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বদা- সর্বদা ছিলেন সোচ্চার। তাঁর লেখা ইসলামি গান ও হিন্দুদের মা কালীকে নিয়ে লেখা শ্যামাসঙ্গীত বাংলাসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। তিনি বাংলা কাবিতায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রগতিশীল প্রণোদনার অগ্রনায়ক হিসেবে সমধিক পরিচিত। তিনি বাংলা কবিতা তথা বাংলাসাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে অগ্রগণ্য। বাঙালি মনীষীর এক অনন্য নিদর্শন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বাংলাভাষার অন্যতম সেরা কবি, গীতিকার, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা-গান, গল্প-উপন্যাস সমানভাবে সমাদৃত ও পাঠ্য। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী ভাবধারার কারণে তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিলো মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার, সামাজিক অনাচার-অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে লেখনির মাধ্যমে সোচ্চার প্রতিবাদ।

বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যধারায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তার ছিলো অবাধ বিচরণ। যুদ্ধের ময়দানেও তিনি লেখনির মাধ্যমেও তার প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর অসংখ্য কবিতা-গানে তা প্রতিফলিতও হয়েছে। বলা হয়, অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো ছিলো তাঁর প্রকাশ। তিনি যেমন লেখাতে বিদ্রোহী ছিলেন, তেমনি ব্যক্তিজীবনে ও কাজে-কর্মেও ছিলেন আপোষহীন। এটাই ‘বিদ্রোহী কবি’র সার্থকতা।

কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া বøকে ছিলো চুরুলিয়া গ্রাম। কবির পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ৬ষ্ঠ সন্তান কবি। পিতা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং পাশের মাযারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ বোন উম্মে কুলসুম। দুঃখের সংসারে জন্মেছিলেন বলে কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। ছেলেবেলায় কবি নজরুল গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজও করেন। পাশাপাশি তিনি মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত¡ অধ্যয়ন চালিয়ে যান।

১৯০৮ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য তাঁকে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হয়। তারপরও তার পড়াশোনা থেমে থাকেনি। এ সময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্নমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওই মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক ও মসজিদের মুয়ায্যিন (আযান দাতা) হিসেবে কাজ চালিয়ে যান।

ছেলেবেলা থেকেই কাজী নজরুলের গানের প্রতি দুর্বলতা ছিলো। তাঁর এক চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের (রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র নাট্যদল) বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন। তিনি লেটো দলে যোগ দেন। জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়াল বাসুদেবের লেটো দলে নজরুলের নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো গান দিয়েই তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। তিনি লেটো দলের সাথে বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন, নাটকের জন্য গান ও কবিতাও লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একই সাথে তিনি কোরআনের পাশাপাশি বেদ-পুরাণও পড়তে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তিনি লেটোদলের জন্য বেশকিছু গান রচনা করেন। এরপর তিনি প্রথমে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে, পরে মাথরুন ইংরেজি হাইস্কুলে ভর্তি হন। যা পরে ‘নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর্থিক সমস্যায় এখানে নজরলের বেশি দিন পড়াশোনা করা হয়নি।

ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর রোজগারের জন্য তাকে আবার লেটোদলে ফিরে যেতে হয়। এরপর এক খ্রিস্টানের খানসামা এবং পরে আসানসোলের একটি রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ তার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে ১৯১৪ সালে তাকে সেখান থেকে নিয়ে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ সালে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান ও অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯১৭ সালের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে ছিলেন। এ সময়ে তিনি তার প্রথম গদ্য বাউÐুলের আত্মকাহিনী, প্রথম প্রকাশিত কবিতা মুক্তি, সমাধি এবং গল্প হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে প্রভৃতি রচনা করেন। বলা যায়, এই সৈনিক জীবনই তাকে কবি-লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

১৯২২ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে তিনি সারা ভারতবর্ষের সাহিত্য সমাজে খ্যাতি লাভ করেন। বিদ্রোহী প্রকাশের পর থেকেই তিনি ইংরেজ সরকারের কোপানলে পড়েন। এ বছর ২৬ সেপ্টেম্বর ধূমকেতু পত্রিকায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয় এবং কবিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি এক বছর কায়েদও খাটেন।

১৯২১ সালে কবি নজরুল প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় কুমিল্লায় আলী আকবর খানের বোন নার্গিস আক্তার খানমের সাথে। আক্ত হবার পর কাবিনে নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘরজামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর ঘরে যাবার আগেই নার্গিসকে রেখে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে আসেন। এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে। তাদের প্রথমে প্রণয় ও পরে পরিণয় হয়। নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি মুসলিম হয়েও তাদের চার সন্তানের নাম বাংলা, আরবি ও ফারসি মিলিয়ে রাখেন। বড় ছেলের নাম কৃষ্ণ মুহাম্মদ, মেজো অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), সেজো কাজী সব্যসাচী এবং ছোট কাজী অনিরুদ্ধ। ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সু-সম্পর্ক বজায় ছিলো।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ সালে নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার পাশাপাশি ‘জাতীয় কবি’র মর্যাদা এবং ‘একুশে পদক’ দেয়া হয়। কবি টানা ৩২ বছর তিনি চলৎশক্তি রহিত অবস্থায় বেঁচে ছিলেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবি নজরুল ইহলোক ত্যাগ হরে চলে যান না ফেরার দেশে।

এবারে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ঘটনাটা খুবই মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক। আজ আমি কাজী নজরুলের একটি মর্মান্তিক ব্যর্থ প্রেম এবং সে ব্যর্থ প্রেমের কারণে ২টি গানের ইতিহাস আপনাদের সামনে তুলে ধরবো। এটা কম-বেশি অনেকের জানা। কাজী নজরুলের প্রায় প্রতিটি কবিতা-গানের পেছনে একটি করে ইতিহাস আছে। কবিপুত্র বুলবুল যখন মারা যায় তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি লিখলেনÑ ‘ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’। এ রকম হাজারো ঘটনা রয়েছে তাঁর গান-কবিতা লেখার নেপথ্যে।

একবার কবি নজরুল রাজশাহীতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে সম্মত হলেন। তখন নজরুল পিক ফর্মে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত, অনেক পাঠকের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। কবি রাজশাহীতে যাবেন এই খবর চাউর হওয়ার পর গোটা শহরে শোরগোল পড়ে গেল। কবি নজরুলকে একনজর দেখার জন্য হাজারো মানুষ উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। এমন কী রাজশাহীর বাইরে থেকেও মানুষ আসার প্রস্তুতি নেয়।

এ খবর শুনে নাম না জানা এক নজরুল-ভক্ত তরুণীও রাজশাহীর সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। সে এরই মধ্যে নজরুলের কবিতা-গানের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে পড়েছে। মনে মনে সে নজরুলকে হৃদয়ের গভীরে ঠাঁইও দিয়ে ফেলেছে। আর তাই প্রিয় কবিকে কাছ থেকে নিজ চোখে একনজর দেখার এই সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চাইলো না। এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়ার একটিকে সার্থক করবে বলে সে মনে করলো। এই তরুণীভক্তটি ছিলো যেমন অসামান্যা সুন্দরী তেমনি শিক্ষিত ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন।

নাম না জানা সেই ভক্ত তরুণী অনুষ্ঠানের দিন বাড়ির কাউকে কিছু না বলে রাজশাহী যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইস্টিমারে উঠে পড়লো। সে জানতো বিষয়টি বাড়িতে জানাজানি হলে তার আর যাওয়া হবে না। মেয়েদের তখন এত স্বাধীনতা ছিলো না। তখনকার দিনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার প্রধান উপায় ছিলো ইস্টিমার। তরুণী পদ্মার ঘাটে এলো। কোনো কিছু না ভেবেই ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা স্টিমারে উঠে পড়লো। ইস্টিমার ছাড়তে খুব বেশি দেরিও ছিলো না। যথা সময়ে ইস্টিমার ছেড়ে দিলো। বসার জায়গা না পেয়ে তরুণী ইস্টিমারের ডেকে রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে রইলো।

পদ¥ার উত্তাল হাওয়ায় তরুণীর চুলগুলো উড়ছে। কোনোভাবেই অবাধ্য চুলগুলোকে সামাল দিতে পারছে না। বারবার দুই হাতে অবাধ্য চুলগুলোকে বাঁধছে আর ভাবছে তার প্রিয় কবির সাথে দেখা হলে কীভাবে সেটা ম্যানেজ করবে, প্রথমে কী বলে কবিকে সম্ভাষণ করবে এসব যখন ভাবছিলো ঠিক তখন হঠাৎ তার স্বপ্নময় ভাবনার ছন্দপতন হলো। ওর সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই তরুণী দেখতে পেল ওর একটু সামনে এক সুদর্শন তরুণ অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তার সুঠাম দেহ ও সুন্দর চেহারা তরুণীকে আকৃষ্ট করলো বটে তবে তার এই হ্যাংলার মতো অসভ্যভাবে তাকিয়ে থাকা ওর পছন্দ হলো না। তরুণী নিজেকে সামলে নিলো। তবে যুবকটির তীব্র চাহনী আর অসভ্যতায় বিব্রতবোধ করতে লাগলো।

তরুণী ওই জায়গা থেকে সরে অন্য দিকে চলে গেল। একটা সিট পেয়ে সেখানে বসে আবার তার প্রিয় কবিকে নিয়ে ভাবনায় বিভোর হয়ে গেল। এই সময় আবার যুবকটিকে দেখলো। এবারও সে তার দিকে আগের মতোই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। তরুণী এবার আর সরে গেল না। সাহসে ভর করে সেই যুবকের দিকে এগিয়ে গেল। সরাসরি যুবকের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর যুবকের চোখের দিকে তাকিয়ে বললোÑ ‘আপনি এমন করছেন কেন? জীবনে কখনও সুন্দরী মেয়ে দেখেননি? লজ্জা করে না এভাবে পথে-ঘাটে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকতে আর উত্যক্ত করতে?’

তরুণী সেই যুবককে আরো কিছু কটু বাক্য বলে নিজ আসনে ফিরে এলো। তরুণীর কথায় যুবক কিছুই বললো না। কোনো প্রতিবাদও করলো না। হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পারলো। শান্ত পায়ে তরুণীর কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে গেল। বাকি সময় আর এলো না। তখন তরুণীও সাচ্ছ¡ন্দবোধ করলো। ইস্টিমার রাজশাহী পৌঁছলো। সে তরুণকে তরুণী আর দেখলো না। তরুণী মনে মনে ভাবলো, এতটা কঠিন করে বলাটা ঠিক হয়নি। সে মনে মনে অনুতপ্ত হলো।

যথাসময়ের অনেক আগেই অনুষ্ঠানে পৌঁছলো তরুণী। সুন্দরী তরুণী তখন প্রিয় কবিকে দেখার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। প্রিয় কবিকে কাছ থেকে দেখবে বলে সে সবার আগে এসে অনুষ্ঠানের একেবারে সামনের দিকে বসেছে। যেন ভালো করে দেখতে পায়। আর অল্প কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান শুরু হবে। তরুণীর বুক দুরুদুরু করছে। দর্শকরাও অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একদল বন্ধু-বান্ধব পরিবেষ্টিত হয়ে কবি স্বভাবসুলভ ধীর পায়ে মঞ্চে এলেন। মঞ্চে এসে তার আসনে বসলেন কবি। আর সেই সুন্দরী তরুণী অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেল তার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর কেউ নয়, পদ্মানদীতে উথাল-পাথাল ঢেউ কেটে চলা ইস্টিমারে তার সাথে অসভ্যতা করা সেই সুশ্রী সহযাত্রী যুবক। তার দিকে তাকিয়ে ছিলো বলে যাকে সে ভৎসর্না করেছিলো।

নজরুল মঞ্চে বসে সরাসরি তরুণীর দিকে তাকালেন। দু’জনের চোখাচোখি হলো। তরুণী লজ্জায়-আত্মগøানিতে চোখ নামিয়ে নিলো, মাথা নিচু করে ফেললো। হায়! হায়!! একী করেছে সে? যাকে সারা জীবন প্রিয় কবির বেদিতে বসিয়ে আরাধনা করেছে, আর আজ তার সাথে সে না জেনে-বুঝে একী আচরণ করলো! এখন অনুশোচনা করা ছাড়া তরুণীর আর কোনো উপায় থাকল না। এমন সময় মঞ্চ থেকে উপাস্থপকের ঘোষণা ভেসে এলোÑ ‘এখন সংগীত পরিবেশন করবেন আমাদের প্রিয় শিল্পী কবি কাজী নজরুল ইসলাম’।

উঠে দাঁড়ালেন কবি। সাথে সাথে বেজে উঠলো হারমোনিয়াম-তবলার সম্মিলিত সুর। এর কিছু পরেই শুরু হলো কবির ভরাট কণ্ঠের গান। এদিন কবি একটি সম্পূর্ণ নতুন গান গাইলেন। কবির প্রায় সব গান তরুণীর কণ্ঠস্থ, কিন্তু এই নতুন গান যা সে আগে কখনও শোনেনি। তার মানে কবি আজই এই গানটি রচনা করেছেন। যা কবি নজরুলের জন্য ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। দরাজ কণ্ঠে কবি নজরুল গাইলেনÑ “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ”

তরুণী বুঝতে পারলো এই গান কবি তাকে নিয়ে লিখেছেন। সে আরো লজ্জা পেল। অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকাতেই তরুণী দেখতে পেল, তার দিকেই তাকিয়ে কবি আনমনে গেয়ে যাচ্ছেন। কবির আশেপাশে বসা তার বন্ধুরাও তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। তরুণী বুঝলো, কবি এসে হয়তোবা বন্ধুদের সাথে ঘটনাটি শেয়ার করেছে। এ কারণে তারা হাসছে। প্রিয় কবির কণ্ঠে তাকে নিবেদিত এরতা সুন্দর একটি গান শোনার পরও তরুণীর বারবার মনে হলোÑ ‘হে ধরণী দ্বিধা হও, আমাকে গ্রহণ করো’।
এরপর তরুণী মাথা নিচু করে পুরো অনুষ্ঠানটা শেষ করলো। একবারও কবির দিকে তাকালো না। লজ্জায় তাকাতে পারলো না। ততক্ষণে অনুষ্ঠান শেষ। অনুষ্ঠান শেষে তরুণীর আর কবির সাথে দেখা করা হলো না। কিসের কবির সাথে দেখা করা, কথা বলা। কোন মুখে কথা বলবে? এখন যেন সে এখান থেকে পালাতে পারলেই বেঁচে যায়।

সেদিনই ফিরতি ইস্টিমারে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো তরুণী। তবে তার মনের মাঝে চলছে উথাল-পাথাল আত্মসমালোচনার ঢেউ। যার জন্য এতো কিছু তার সাথে প্রথম দেখায় সে একী আচরণ করলো! সে তো পত্রিকায় কবির ছবিও দেখেছিলো। তারপরও কেন প্রিয় কবিকে চিনতে পারলো না? নিজের প্রতি খুব ঘেন্না হলো। কবির সাথে নিজ আচরণের জন্য তরুণী কিছুতেই যেন নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। এই ঘটনা তাকে এতোটাই আত্মগøানিতে ডোবাল যে তরুণী তার নিজের স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে ফেললো। এক পর্যায়ে সে নিজের জীবন নিয়ে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। তরুণী পদ্মা-নদীর পাঁকখাওয়া ঘোলা জলের দিকে তাকালো। ঘন অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারেও তার মনে হলো, পদ্মার ঢেউগুলোও যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার বারবার মনে হচ্ছে, পদ্মার বুকেই যেন সব শান্তি লুকিয়ে আছে। যত কাল বেঁচে থাকবে আত্মগøানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। পদ্মার অশান্ত ¯্রােতধারা যেন ওর সকল গøানি মুছে দিতে ডাকছে। তারচেয়ে এই ভালো। আর কোনো কিছু না ভেবে রাতের অন্ধকারে সেই অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী ডেক থেকে পদ্মার জলে ঝাঁপ দিলো। পদ্মার তীব্র ¯্রােতধারা নিমিষে তাকে তলিয়ে নিয়ে গেল সীমাহীন অতলে।

কবি নজরুল রাজশাহীতে থাকা অবস্থায় শুনতে পেলেন তার অচেনা সেই ভক্ত-তরুণীর পদ্মায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার করুণকাহিনী। সেই ভক্ত তরুণীর মৃত্যুতে তার কবিহৃদয়ও হাহাকার করে উঠলো। আর জন্ম নিলো আরো একটি কালজয়ী গান। “পদ্মার ঢেউরে, মোর শুন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যারে…” তরুণী বেঁচে থাকলে কী গত সেটা আমার জানা নেই। তবে তার মৃত্যু একটি ইতিহাসের জন্ম দিয়ে গেল আর সৃষ্টি হলো ২টি কালজয়ী গান।

২৯ আগস্ট প্রিয় কবির ৪২তম মৃত্যুদিবস। কবিকে নিয়ে আমার লেখা ৪ লাইনের একটি অণুকবিতা দিয়ে কবির আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে লেখা শেষ করবে।

 

নার্গিস

আমেরিকায় একা কবরে শুয়ে আছো তুমি
শাহবাগে নীরবে ঘুমায় একা কবি নজরুল,
অভিমানে দূরে রইলে দু’জন সারাটি জীবন
মরণেও ভাঙলো না তো তোমাদের ভুল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here