অন্যধারা ডেস্ক : কাঁদো নদী কাঁদো মূলত চেতনাপ্রবাহরীতিতে রচিত একটি উপন্যাস। এতে চেতনায় প্রবহমান ধারার মাধ্যমে চরিত্র, আখ্যান ও তার অন্তর্গত বাণী রূপায়িত হতে থাকে। ভাবনার প্রবাহ , ফ্ল্যাশব্যাক তথা চেতনাপ্রবাহরীতির মাধ্যমে তা প্রকাশ করতে গিয়ে যে-কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে তা উপন্যাসটিকে জটিল করে তুলেছে। বস্তুত চেতনাপ্রবাহরীতির জটিলতম কৌশলই এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিংবা লেখক এক্ষেত্রে চেতনাপ্রবাহরীতি এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে, তা এমন জটিল হয়ে উঠেছে।
উপন্যাসটির পরিকল্পনা, প্রকরণ ও শৈলীগত অভিনবত্ব সত্ত্বেও এবং কাহিনি বর্ণনার এক বিশেষ ধরন ও বাঁকানো ধাপ অতিক্রম করার পদ্ধতি গ্রহণের পরও উপন্যাসের কাহিনিগত মৌল কাঠামো একেবারেই বঙ্গজ এবং পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম বাঙালি পরিবারের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার মতোই আটপৌরে।
প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুহাম্মদ মুস্তফারই অবচেতন মনের বিবৃতি। এরূপ আঙ্গিকের জন্য চরিত্রের মতো আখ্যানভাগও আপাত জটিল ও খাপছাড়া বলে প্রতিভাত হয়। একদিকে নিয়তিতাড়িত মুহাম্মদ মুস্তফার করুণ জীবনোপাখ্যান, অপরদিকে শুকিয়ে যাওয়া বাঁকাল নদীর প্রভাবতাড়িত কুমুরডাঙ্গার মানুষের ব্যতিব্যস্ত জীবনচিত্র জীবন ও নিসর্গ, বাস্তব ও পরাবাস্তব, মানবচৈতন্য ও অবচেতনা, বিশ্বাস ও সংস্কার- সবকিছু মিলে অস্তিত্ববাদ ও নিয়তিবাদের সমন্বয়ে এক অভিনব ও জটিল শৈল্পিক নৈপুণ্যে গ্রন্থখানি বাংলা উপন্যাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
কাঁদো নদী কাঁদো শুরু হয়েছে একেবারে শেষ থেকে অর্থাৎ সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর। উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য অংশ হলো কুমুরডাঙার অবস্থা। লেখক সেখানকার অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন। কাহিনী গড়ে উঠেছে বাঁকাল নদী ও কুমুরডাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। বাঁকাল নদীতে চড় পড়ার কারণে স্টিমার আসবে না। তাতে শহর বহিবিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এতে জনজীবন হয়তো কিছুটা শীতল হয়ে যেতে পারে। চড়ের কথাটা প্রথমে শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তি উকিল কফিলউদ্দীনও বিশ্বাস করতে পারেনি। তার কণ্ঠে সন্দেহের সুর।
স্মৃতি-অনুষঙ্গবাহী আত্মসংলাপে এর বিভিন্ন বিষয় বা ঘটনা বর্ণিত হয় সেও আসলে কাঁদো নদী কাঁদোর মূল উপস্থাপক নয়, যার মাধ্যমে চেতনাপ্রবাহরীতিতে তা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে বস্তুত তিনি এক সর্বজ্ঞ। পাঠককে প্রথমত সর্বজ্ঞ এই ঔপন্যাসিক, পরে তবারক ভুইঞার আত্মসংলাপকে অবলম্বন করে মূল ঘটনা বা বিষয়ে পৌঁছতে হয়।
পুরো উপন্যাসেই তবারক বলছে কুমুরডাঙা শহর, বাঁকাল নদী ও তীরবর্তী অধিবাসীদের জীবনযাত্রা ও তৎকালীন সময়ের নানা বর্ণনা। কুমুরডাঙা জীবনের ইতিহাস, বাঁকাল নদীতে চর জেগে উঠার ফলে স্টিমার বন্ধ হয়ে বস্তুগত জীবনের ক্ষয়ক্ষতির ইতিহাস।
লেখক এই দুই কথকের মাধ্যমেই কুমুরডাঙার মানুষ ও মুস্তফার যোগসূত্র ঘটিয়েছেন। মুস্তফার পিতা অতিশয় দুর্বৃত্ত প্রকৃতির। মুস্তফা বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজের চেষ্টায় উচ্চশিক্ষা লাভ করে এবং কুমুরডাঙার ছোট হাকিম হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। এবং সেখানকার প্রাক্তন এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীর মেয়ের সাথে তার পরিচয় সূত্রে প্রণয় ও এক পর্যায়ে বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের কথা মুস্তফা চিঠির মাধ্যমে নিজ বাড়িতে জানায়। কিন্তু সে চিঠি বাড়িতে পৌঁছানোর পর সেখানে ঘটে যায় এক করুণ কাহিনী।
অন্যধারা/সাগর