কাজী নজরুলের ধর্মীয় সম্প্রীতির বহি:প্রকাশ

ড. মিল্টন বিশ্বাস:
‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা/ ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা,/ ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ/ ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/ এক মানবের একই রক্ত মেশা/ কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা!’’‘পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব শোন মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।’ বিশ শতকজুড়ে হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব; অন্যদিকে লোভী মানুষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণস্তূপের মতো জমা হয়ে থাকা- এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন; কবিতা ও প্রবন্ধে সাম্য, কল্যাণ ও ঐক্যের বাণী শুনিয়েছিলেন।
‘গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ ‘মানবতার এই মহান যুগে একবার/গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে,/তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমানও নও,/তুমি মানুষ- তুমি ধ্রুব সত্য।’
উপরের উদ্ধৃতিগুলো স্মরণে রেখে কাজী নজরুল ইসলামের(১৮৯৯-১৯৭৬) ৪৬তম প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রবন্ধে প্রকাশিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা সম্পর্কে আলোকপাত করা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই তাৎপর্যবহ। এদেশ এখনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। কিন্তু যে দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাঁধে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা ছিল তাও সম্পন্ন হয়নি। এজন্য একমাত্র ভরসা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল। বিশেষত নজরুলের জীবনব্যাপী(সুস্থ ছিলেন ১৯৪২ পর্যন্ত) সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বলে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে অনুপ্রেরণার অজেয় উৎস। কেবল তাঁর কবিতা-গান নয় প্রবন্ধে রয়েছে বিবেক জাগানিয়া অনন্যসব ভাবনাসমূহ। সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ, অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু, সাপ্তাহিক লাঙল, গণবাণী, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা প্রভৃতি পত্রিকায়- এ সম্পর্কে নজরুলের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ এবং অভিভাষণের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। পরে সেগুলো যুগবাণী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র-মঙ্গল গ্রন্থে প্রবন্ধ সংকলনে স্থান পায়। বলাবাহুল্য তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সমকালীন প্রসঙ্গ নিঃসৃত। আর এই সমসাময়িক প্রসঙ্গের অবতারণার জন্য তাঁর প্রবন্ধসমূহ মূল্যবান হয়ে উঠেছে। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত বিশ্ব পরিম-ল ও ভারতবর্ষের সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস নজরুল-সাহিত্যকে আলোড়িত করেছে। তবে তিনি তাঁর অভিমতসমূহ ব্যক্ত করার সময় সর্বজনীন মানুষের কল্যাণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষের বিপরীতে তিনি সম্প্রীতির প্রত্যাশায় উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। একইসঙ্গে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে ধর্ম, শিক্ষা ও সমাজ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও তাঁর ভাবনাসমূহ গুরুত্ব বহন করে। অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পর্কে লিখেছেন-‘উপনিবেশকে আঁকড়ে রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল ভারতবর্ষে ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারবার। এর পশ্চাতে ছিল একাধিক রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ নজরুলকে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি সচেতনভাবে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেছেন। সত্য-সুন্দর-কল্যাণের পূজারি নজরুল চেয়েছেন সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে মানুষের মুক্তি। বস্তুত, সাম্যবাদী চিন্তা তাঁর মানসলোকে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছেÑহিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে তাঁর চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার পরিপূরক দুই শক্তি।’ (উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব ও নজরুলসাহিত্য, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, ২য় খণ্ড, পৃ ৩৩৬) সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভেদ ও অনৈক্য সম্পর্কে নজরুল ইতিবাচক চিন্তা করেছেন। সাম্প্রদায়িক কলহের দুর্বলতা দিয়ে ভারতের মুক্তি সম্ভব নয়। নজরুল এ-কারণেই ভারতীয়দের শক্তির দুর্বলতর সূত্রগুলি ‘যুগবাণী’ ও অন্যান্য পর্বের সম্পাদকীয় রচনায় বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি জানতেন হিন্দু মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ শক্তির দুর্বার আঘাতেই ব্রিটিশ শাসনশৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব। নজরুল আহ্বানও জানিয়েছেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের। তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য-চিন্তা-চেতনার ভাব বিনিময়ে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম এডুকেশন (মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা, রুদ্র-মঙ্গল) সোসাইটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেছেন : ‘ভারত যে আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয়নি শুধু আয়োজনেরই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা।’ হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনার এই তীব্রতা নজরুলের মানবতাবোধ থেকে উৎসারিত। তাঁর সাহিত্যচিন্তার অন্যতম স্তম্ভও এটি ছিল। এজন্য তাঁর ‘আমার সুন্দর’ প্রবন্ধের একটি অংশ স্মরণীয়- ‘আমার কেবলই যেন মনে হত আমি মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছি। জাতি-ধর্ম-ভেদ আমার কোনদিনই ছিল না, আজও নেই। আমাকে কোনোদিন তাই কোনো হিন্দু ঘৃণা করেনি। ব্রাহ্মণেরাও ঘরে ডেকে আমাকে পাশে বসিয়ে খেয়েছেন ও খাইয়েছেন। এই আমি আমার যৌবন-সুন্দর, প্রেম-সুন্দরকে দেখলাম।’ নিজে মুসলিম হয়েও হিন্দু নারী প্রমীলাকে বিবাহ করা এবং একাধিক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় নজরুলের পক্ষে এ ধরনের কথাই স্বাভাবিক। তিনি সাম্য ও মানবকল্যাণে বিশ্বাসী ছিলেন। ফলে সর্বপ্রকার বন্ধন ও অধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। সমাজজীবনের অনাচার অসঙ্গতি তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন-শুধু রাজনৈতিক সূত্র থেকে তা অর্জন করেননি। সমাজকে ভেঙে গড়বার স্বপ্ন ও উদ্যম ছিল তাঁর ক্লান্তিহীন। ‘মোহররম’ প্রবন্ধে মাতম-অভিনয়কে ধিক্কার দিয়ে সত্যের পক্ষ নিয়ে নির্যাতনের প্রতিবাদে রক্ত দেবার আহ্বান জানিয়েছেন নজরুল। প্রথার অন্তরে নিহিত সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। লিখেছেন-‘এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ! এস ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গণ্ডি কাটাইয়া, সব সঙ্কীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’ ‘মন্দির ও মসজিদ’ আর ‘হিন্দু-মুসলমান’ নামে দুটি রচনাতে ভারতবর্ষের প্রধান দুই সম্প্রদায়ের পরস্পর বিদ্বেষ এবং হানাহানিকে নজরুল তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সবসময়ই সচেতন ছিলেন। ‘মন্দির ও মসজিদ’-এ দাঙ্গা নিয়ে তাঁর বেদনাঘন কথা আছে। মানবতার দিকে যারা ফিরেও তাকায় না তারা ছোরা আর লাঠি নিয়ে নিজের ধর্মসম্প্রদায় রক্ষা করে! নজরুলের মতে, ‘ইহারা ধর্মমাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের অ্যালকোহল পান করিয়াছে।’ শাস্ত্রীয়প্রথাকে নজরুল সবসময়ই মানবতার নিচে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘মারো শালা যবনদের!’ আর ‘মারো শালা কাফেরদের!’ হাঁক ছেড়ে মাতালের চিৎকার দিয়ে তারা নাকি আল্লাহ্ এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষা করে। আর মারণ আঘাতে লুটিয়ে পড়লে তারা সকলেই আল্লাহ্ বা মা কালীকে না ডেকে ‘বাবা গো, মা গো’ বলে চিরকালের বাঙালির মতো একইভাবে কাতরায়! ‘হিন্দু-মুসলমান’ লেখাতেও রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়ে নজরুল বলেছেন, ‘যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজ কাটবে কে?’ টিকি আর দাড়ি হচ্ছে মানুষের সেই ন্যাজ। এ ন্যাজ মাথায় আর মুখে নয়, গজিয়েছে মনের গভীরে; তা থেকেই এত বিদ্বেষ। আর, দাড়ি কামানো খায়রু মিয়া ছুরি খেলে, কিংবা ‘তুর্কিছাঁট-দাড়ির শশধর বাবু’ ছুরি খেলে প্রথম ক্ষেত্রে মুসলমান আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে হিন্দু শব নিয়ে কবরস্থান বা শ্মশানে ছোটে না। দুঃখ এই, ‘মানুষ আজ পশুতে পরিণত হয়েছে, তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে। পশুর ন্যাজ গজিয়েছে ওদের মাথার ওপর, ওদের সারা মুখে। ওরা মারছে… টিকিকে, দাড়িকে। বাইরের চিহ্ন নিয়ে এই মূর্খদের মারামারির কি অবসান নেই!’ আসলে ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য’ নজরুলের অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল। যৌবনের প্রতি এই কবির আবেদন, ‘আমার ধর্ম যেন অন্য ধর্মকে আঘাত না করে, অন্যের মর্মবেদনার সৃষ্টি না করে।’ একই দেশের ফুলে-ফসলে পুষ্ট দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ অত্যন্ত নিন্দনীয়। অথচ সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক নেতারা নিজ নিজ সম্প্রদায়কে ‘ধর্মের নামে উগ্র মদ পান’ করিয়ে অযথা মাতাল করে তুলে বিরোধ সৃষ্টি করছেন। আর শিক্ষা-বঞ্চিত সাধারণ মানুষকে করে তুলেছেন নিজেদের হাতের পুতুল। রাজনৈতিক নেতারা চারপাশে ‘ভাড়াটিয়া মোল্লা মৌলবি পণ্ডিত পুরুত’ জুটিয়ে নিয়ে তাদের দিয়ে আপন আপন সম্প্রদায়ের পক্ষে ওকালতির ব্যবস্থা করেন। নজরুলের কথা, তরুণরা যেন ‘কদর্য’ হানাহানির ঊর্ধ্বে থাকে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘ইসলাম ধর্ম কোনো অন্য ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করিতে আদেশ দেন নাই। ইসলামের মূলনীতি সহনশীলতা। পরমত সহনশীলতার অভাবে অশিক্ষিত প্রচারকদের প্রভাবে আমাদের ধর্ম বিকৃতির চরম সীমায় গিয়া পৌঁছিয়াছে।’ যুবসমাজের উদ্দেশে বলেছেন, ‘মানুষকে মানুষের সম্মান দিতে যদি না পারেন, তবে বৃথাই আপনি মুসলিম।’ মুসলমানদের ভুল আর পশ্চাদ্পদতা বিষয়ে লেখকের ওই দুর্ভাবনা এ যুগের জন্যেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নজরুলের ‘শেষকথা’, ‘আমরা যৌবনের পূজারী, নব-নব সম্ভাবনার অগ্রদূত…।’ পৃথিবীর অগ্রগামী পথিকদের সঙ্গে সমতালে পথ চলব। পরস্পর যাবতীয় বিভেদ ভুলে সঙ্ঘবদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ করবার চেষ্টা করেছেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলাম লক্ষ করেছেন ভারতবর্ষের অগ্রগতি বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আভিজাত্যবোধের কারণে। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য সাধনের মাধ্যমে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করায় নজরুল ছিলেন আন্তরিক। হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মূলে উভয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক জ্ঞানবিমুখতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। সমাজ-অন্তর্গত একটি সম্প্রদায়ের মানুষ কুসংস্কার, গোঁড়ামি, বৈষম্য, সংঘাত, দাঙ্গায় সভ্যতা-সমাজ-সময়-রাষ্ট্রের গতিশীলতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে; নজরুল সেই সম্প্রদায়-অন্তর্গত সকল মানুষকে রক্ষণশীল কুসংস্কারাচ্ছন্ন জগত থেকে আলোকিত পৃথিবীতে পদচারণার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন- ১. আজ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে, একজনও চিত্রশিল্পী নাই, ভাস্কর নাই, সঙ্গীতজ্ঞ নাই, বৈজ্ঞানিক নাই, ইহা অপেক্ষা লজ্জার আর কি আছে?’(তারুণ্যের সাধনা) ২. দেয়ালের পর দেয়াল তুলে আমরা ভেদ-বিভেদের জিন্দাখানার সৃষ্টি করেছি; কত তার নাম সিয়া, সুন্নি, শেখ, সৈয়দ, মোগল, পাঠান, হানাফি, শাফি, হাম্বলি, মালেকি, লা-মাজহাবি, ওহাবি ও আরো কত শত দল। … সকল ভেদ-বিভেদের প্রাচীর নিষ্ঠুর আঘাতে ভেঙ্গে ফেল।’(বাংলার মুসলিম বাঁচাও) এভাবেই উভয় সম্প্রদায়ের বিরোধের প্রাচীর ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন কবি। নজরুল অন্য ধর্মের কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার আর প্রাচীন প্রথার অবরোধগুলো উন্মোচন করে মানুষের পারস্পরিক মিলনের মাধ্যমে সম্প্রীতি তৈরি করতে চেয়েছেন। হিন্দুসমাজের অস্পৃশ্যতা সম্বন্ধে কবির অভিমত- ‘হিন্দু ধর্মের মধ্যে এই ঘূত্ম্কারূপ কুষ্ঠ রোগ যে কখন প্রবেশ করিল তাহা জানি না, কিন্তু ইহা যে আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃদের একটা বিরাট জাতির অস্থিমজ্জায় ঘুণ ধরাইয়া একেবারে নির্বীর্য করিয়া তুলিয়াছে, …।  আবার কবি মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, হিন্দু যেমন আরবি-ফারসি-উর্দু জানে না, তেমনি সাধারণ মুসলমান বাংলাও ভালো করে আত্মস্থ করে না, সেখানে আরবি-ফারসি শিক্ষার প্রশ্ন অবান্তর। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে লিখিত একটি পত্রে নজরুল জানিয়েছেন- ‘হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে, এ পোড়া দেশের কিছু হবে না…।’ সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য নজরুল সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। কোনো সম্প্রদায়ের সমাজে তিনি মানুষকে বন্দি করেননি। শৃঙ্খলিত-নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম, হতভাগ্যের জাগরণ, পদানত-শোষিত মানুষের মুক্তি-প্রত্যাশায় তিনি মানুষকে জাতি-ধর্ম-সমাজ মন্দির-মসজিদ ও গ্রন্থের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন, মানবতার সপক্ষে বাজিয়েছেন সাম্যের সুরধ্বনি। ১৯২৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী নজরুলের হৃদয়-উৎসারিত বাণী হলো-‘যিনি সকল মানুষের দেবতা, তিনি আজ মন্দিরের কারাগারে, মসজিদের জিন্দাখানায়, গীর্জার মধ্যে বন্দী। মোল্লা-পুরুত, পাদরী-ভিক্ষু জেল-ওয়ার্ডের মত তাহাকে পাহারা দিতেছে। আজ শয়তান বসিয়াছে স্র্রষ্টার সিংহাসনে।… মানুষের কল্যাণের জন্য ঐ-সব ভজনালয়ের সৃষ্টি, ভজনালয়ের মঙ্গলের জন্য মানুষ সৃষ্টি হয় নাই। আজ যদি আমাদের মাতলামির দরুন ঐ ভজনালয়ই মানুষের অকল্যাণের হেতু হইয়া উঠে- যাহার হওয়া উচিত ছিল কল্যাণের। সেহেতু ভাঙ্গিয়া ফেল ঐ মন্দির-মসজিদ!’(মন্দির ও মসজিদ) ধর্মের ব্যাপারে নজরুল ছিলেন উদার। ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন-‘নজরুল ইসলাম কোন বিশেষ ধর্মের অনুসারী ছিলেন বলা যায় না। তিনি দেশ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান উদারতায় ভালবাসতে পেরেছেন।’ (বিচিত্র-চিন্তা) এক ধর্মের সত্য-সন্ধানীরা অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মুসলমান সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তাঁর আন্তরিকতার প্রকাশ রয়েছে ‘আমার লীগ কংগ্রেস’ প্রবন্ধে। নজরুল তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়’। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বোধিত নজরুল হিন্দু-মুসলিম মিথকে একইসঙ্গে প্রবন্ধের বক্তব্যে ব্যবহার করেছেন। যেমন-ক) আজ নারায়ণ আর ক্ষীরোদসাগরে নিদ্রিত নন। (নবযুগ) খ) ঐ শোনো মুক্তিপাগল মৃত্যুঞ্জয় ঈশানের মুক্তি-বিষাণ। ঐ শোনো মহামাতা জগদ্ধাত্রীর শুভ-শঙ্খ! ঐ শোনো ইসরাফিলের শিঙ্গায় নব সৃষ্টির উল্লাস ঘন রোল! (নবযুগ)। এ সম্পর্কে কবি লিখেছেন-‘আমি হিন্দু-মুসলমানের পরিপূর্ণ মিলনে বিশ্বাসী; তাই তাদের এ সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্য অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি হয়েছে। তবু আমি জেনেশুনেই তা করেছি।’ বস্তুত বিশ শতকজুড়ে হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব; অন্যদিকে লোভী মানুষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণস্তূপের মতো জমা হয়ে থাকা- এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন; কবিতা ও প্রবন্ধে সাম্য, কল্যাণ ও ঐক্যের বাণী শুনিয়েছিলেন। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার সেই প্রচেষ্টাকে স্মরণে রেখে, অনুশীলন করে একুশ শতকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সাম্যবাদী সমাজ।

 

অন্যধারা/ ২৭ আগস্ট, ২০২১/ দ ম দ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here