(অণুগল্প)
কুকুর
অর্ণব আশিক
শফিক তখন কলেজে পড়ায়- মানে কলেজ শিক্ষক। বেসরকারি কলেজ কম বেতন, সময় মতো বেতন না হলেও, বেতন পাওয়া যেতো। বিয়ে করেছে, দু’টি মেয়ে, এক ভাই এক বোন, এক ভাগ্নে ও এক ভাগ্নি নিয়ে সংসার। বড় মেয়েটি সদ্য স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। ভাই বোন ভাগ্নে ভাগ্নি সবাই স্কুল কলেজে পড়ে। মাঝে মাঝে বাবা-মা আসেন। বাবা আসার সময় বাড়ি থেকে চাউল ও মাঝে মাঝে তরিতরকারি নিয়ে আসেন। তবে তাঁরা এলে অন্য বোনরাও চলে আসে ছেলে মেয়ে নিয়ে, বেড়াতে। শফিকদের বাসাটা তখন আনন্দে ভরপুর থাকে। চাঁদের হাট হয়। যদিও শফিকের কষ্টটা শুধু বেড়ে যায়, সংসার চালোনোর কষ্ট। মেয়েটাকে একজন শিক্ষক রেখে দিতে পারেনি। কিন্তু ভাই বোন ভাগ্নে ভাগ্নি প্রত্যেকের জন্য মাস্টার রেখেছে। ওদের স্কুল কলেজের বেতন, বই, প্রাইভেট টিচারের বেতন কখনো বন্ধ থাকেনি। শফিকের বউ বলতো তোমারইতো ভাই-বোন ভাগ্নে-ভাগ্নি, ওরা মানুষ না হলে তোমারই বদনাম হবে। কথাটা যৌক্তিক। ওরা পড়ালেখা করেছে।
আজ তার বাবা-মা নেই। ভাই-বোন বিয়ে হয়েছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে আছে। ভাগ্নে-ভাগ্নিও যার যার সংসার, ছেলে-মেয়েও কর্ম নিয়ে আছে, সবাই ভালো আছে। শফিকের বড় মেয়েটিরও বিয়ে হয়েছে। ওরা ওদের মতো আছে। সুখেই আছে। শফিক অবসর জীবনের স্বাদ নিচ্ছে। অর্থ বিত্তহীন। নিজে চাকরির টাকা ছাড়া অতিরিক্ত সম্পদ কামাই করেনি। শফিক বলে, ‘আমার কামাই করার যোগ্যতা ছিলো না অথবা নীতিগতভাবে আমি পারিনি। ‘ শফিক এখন বেকার, অবসরে। এখন খোঁজ কেউ নেয় না, তাকে আর প্রয়োজন নেই কারো। একদিন শফিকের এক ভাগ্নে তার বড় মেয়েকে ফোন করে কথায় কথায় বললো, ‘মামি আমাকে ভাত খাওয়া শিখিয়েছে, গোসল করিয়েছে, বসে বসে সন্ধ্যার পর বহুদিন পড়িয়েছে, স্কুলে যাওয়ার সময় বইখাতা গুছিয়ে দিতো। ‘শফিকের মেয়ে হাসতে হাসতে বললো’ আমার বাবা-মা সেখানেই হয়তো জীবনের প্রথম ভুল করেছে’।
আজকাল বিকালে একটু হাঁটতে যায় শফিক। সেদিন হেঁটে বাসায় ফিরেছে, দেখলো একটা কুকুর রাস্তার পাশে কুইকুই করছে। কষ্ট হলো। ভাবলো ক্ষুধায়। দুই টাকার মুড়ি কিনে কুকুরটাকে খেতে দিলো। কুকুরটি শফিকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুড়ি খেতে শুরু করলো। চোখভরা কৃতজ্ঞতা তার। শফিক চলে এলো। আজকাল প্রায়ই কুকুরটার সাথে শফিকের দেখা হয়। মাঠে হাঁটতে থাকলে কুকুরটি তার সাথে সাথে হাঁটে। সে ভেজা গেঞ্জি রেখে মাঠের পাশের ওয়াশরুমে গেলে কুকুরটি নিজ থেকে পাহারা দেয়। সন্ধ্যার পর হাঁটতে গেলেও তার সাথে সাথে ঘোরে। শফিকের সাথে চলে আসে। শফিকের বউয়ের কুকুরটার প্রতি একটু মায়া হয়, আবার কৃতজ্ঞতাও। প্রতিদিন তাার স্বামীর সাথে থাকে, হয়তো তাই। প্রতিদিন তাকে কিছু না কিছু খেতে দেয়। রাতে শফিকের বাসার গেইটে ঘুমায়। অপরিচিত কেউ এলে ঘেউ ঘেউ করে জানান দেয়।
শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না শফিকের। আজকাল যে অবস্থা চলছে চতুর্দিকে, খুব চিন্তা হয় তার। কখন কি হয়। অসুস্থ হলেও একটু আত্মিক ও মানসিক সাহায্য করারও কেউ নেই। শুধু কুকুরটা শফিকের সাথেই থাকে। সে নিরবে সব দেখি আর ভাবে কলেজে শিক্ষকতা করার সময় কেন একটা কুকুর পালন করলাম না।
সাপ্তাহিক অন্যধারা/২২ এপ্রিল-২০২০/জেডএন