পাচার চক্রের তথ্য সংগ্রহের জন্য বসন্তের ভোরে একটা সুপার ফ্রেলন হেলিকপ্টার থেকে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হল বান্দরবনের উদ্নিপাড়ার দক্ষিণ-পূবের এক পাহাড় চূড়ায়। সোনালি সূর্য পূব আকাশে উদিত হওয়ার সাথে সাথেই উত্তর-পশ্চিমে পায়ে হেটে চলে এলাম টিন্ডুতে। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়িসহ একজন সহকারীকে পেলাম, যার কোড সাইন হল “সাইলো”। এ রকম কাজে অনেক ক্ষেত্রে এসব ভ্রাম্যমান সহকারীর ব্যক্তিগত পরিচয় দেওয়া হয় না। শুধু একটা কোড ব্যবহার করেই তাকে চিহ্নিত করতে হয়। আশা করেছিলাম একজন যুবক কিংবা একজন বৃদ্ধ। কিন্তু সাইলো কোড সাইন নিয়ে যে এল তাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। চঞ্চলা এক তরুণী। বুঝলাম ব্যাপারটা। আসলে আমাদের যুগল বানিয়ে পাঠানো হয়েছে। আড়ালে যেন আসল কাজটা উদ্ধার করা সহজ হয়।
মেয়েটা বেশ লম্বা। একবার মনে হল, টানা চোখ দু’টো গভীর কালো। আবার মনে হল মণিতে মিশে থাকা নিকষ কালো ও গাঢ় নীল রং রাতের প্রাণীর গভীর দৃষ্টির মত জ্বলজ্বল করছে। পরনে চক্চকে সাদা পোশাক। পরিপাটি। বিন্দুমাত্র সৌন্দর্য লুকানো সম্ভব হয়নি। অদ্ভুত রূপ আমার চোখ ঝলসে দিল। পিঠ বেয়ে নেমে এসেছে রাতের আধারের মত কালো দীর্ঘ কেশ। বর্ণনাতীত সুন্দর দেহবল্লরী। রহস্যময়ী। ঝড়-বৃষ্টির যেমন, ঠিক তেমন যেন এই রূপসী। পরবর্তী গন্তব্য আরও উত্তর-পশ্চিমের থান্চি। এরপর শুধু ঘুরে বেড়ানো। যেন একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা জীবনের স্বাদ ভোগে ব্যস্ত। কিন্তু এর আড়ালে আসল কাজটা ঠিক-ই কুড়িয়ে চলছি।
বারো ঘন্টা পার হওয়ার আগেই আবিষ্কার করলাম মেয়েটা আমাকে সর্বনাশোর মত টানছে। এমন চুম্বকীয় শক্তির আড়ালে ছলনার যে পাহাড় থাকে তা আমি অনেক আগ থেকেই জানি। এমনকি সেই চূড়া থেকে লাফ দিয়ে পড়ে ক্ষত বিক্ষত হওয়ার বাকিও নেই। এমন রূপসীদের হাত ও ঠোঁটে বরাবর-ই অন্য কারো গন্ধ থাকে। মেয়েটার আসল পরিচয় জানলাম। নীরা তার নাম। সেনাবাহিনী থেকে তাকে তুলে আনা হয়েছে। আর এটাও জানলাম, এটাই তার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। তিন দিন ধরে আমরা ঘুরছি। আলিকদম হয়ে বাইশারি। তারপর গর্জনিয়া হয়ে নাইখংছড়ি। এখানে এসে একটা কর্টেজ ভাড়া করলাম। কাজ মোটামুটি শেষ করে এনেছি। কিন্তু নীরা নামের মেয়েটা ততক্ষণে আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাইলাম। কিন্তু কীভাবে যেন জেনে গেল সেই প্রতারিত হওয়া হৃদয়। বাধা হয়ে দাড়াল।
তারপরও নীরা আমাকে ভাসিয়ে দিতে চাইল বসন্তের বাতাসে। আমি নীরাকে বললাম আমার অতীত। দেখালাম ক্ষত হওয়া হৃদয়। তাকে জানালাম- আমার মাঝে কোনো আশা নেই। সবই তার দৃষ্টির ভুল। আমি আসলে প্রেমিক পুরুষ নই। সবই মনের ভেতর দোলা দেওয়া বসন্ত বাতাস। আমাকে ভালোবাসা এক সময় তার কাছে হবে- উৎপত্তিতেই নিঃশেষিত হওয়া অনুভূতি।
চতুর্থ দিন সকালে কটজের বারান্দায় দাড়িয়ে নীরা যখন অশ্রুসজল হয়ে আমার কাছে নিজেকে সমর্পন করতে চাইছে ঠিক তখন-ই হঠাৎ করে একটা গুলির শব্দ হলো। স্বভাবজনিত কারণে নীরাকে নিয়ে দ্রুত মেঝেতে ঝাপিয়ে পড়লাম। বুলেটটা নীরার জামার ডান হাতে একটা ছিদ্র করে চলে গেল।
দৌড়ে রাস্তায় নেমে এলাম। কিন্তু আততায়ীর কোনো চিহ্ন পেলাম না। এটা খুবই স্বাভাবিক। শত্রু জেনে গেছে আমাদের ভূমিকা। তাই এ রকম নিজেদেরকে উন্মুক্ত না রেখে মুহূর্তের মধ্যে ত্যাগ করলাম কটেজ। নীরা চুপ হয়ে গেল। যদিও সে কঠোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তবুও এভাবে মৃত্যু ছুঁয়ে গেলে কার না শীতল শিহরণ বয়ে যায়। তবে, নীরার মাঝে আরও কি যেন একটা ছিল যা আমি ধরেও ধরতে পারিনি। হয়তো প্রেম, নয়তো মৃত্যুভয়।
দক্ষিণ-পশ্চিমে হালদিয়া পালং এর দিকে যাচ্ছি আমরা। উদ্দেশ্য হাইওয়ে উঠা। কিছুটা যাওয়ার পরই ভাগ্য প্রতারণা করলো। আগাম কোনো সতর্কবানী না দিয়ে হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে গেল গাড়ি। ঠিক করার চেষ্টা করতে লাগলাম। বনেট উঠিয়ে কাজ করছি নীরবে। আর নীরা চুপ করে দাড়িয়ে আছে আমার পেছনে। বসন্ত বাতাস মনের মাঝে আলাদা একটা দোলা দিচ্ছে। ভাবছি নীরাকে নিয়ে। আর কত এভাবে জীবন থেকে পালাব? এবার একটু থামলে কেমন হয়?
হঠাৎ কেমন যেন একটা অনুভূতি হল। ঘুরলাম পেছনে। নীরা নেই। চারপাশে যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও তার কোনো চিহ্ন নেই। র্দূভাবনা এলো মনে। আমার অন্তরে জ্বলে উঠল বিশাল এক আগুনে কু-। আর তার মাঝে পুড়তে লাগল প্রেমময় একটা মেয়ের আহবান। তারপর ডান পাশের ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলো এক যুবক। নিজের ওপর হামলা এসেছে মনে করে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখালাম। কিন্তু দেখলাম সে রকম কিছু নয়। যে এসেছে সে নিজেই ভাঙাচোরা। ছন্নছাড়া মানুষ যেমন হয় সেও তেমন। আরও অবাক হলাম যখন তাকে চিনতে পারলাম। দৌড়ে গেলাম তার কাছে। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের ফাক দিয়ে বেরিয়ে এল “সামিন”!
সামিনের সাথে আমার প্রথম এবং একমাত্র দেখা মায়ানমারের ইরাবতি নদীর তীরে এক বৃষ্টি¯œাত বিকেলে। জায়গাটা প্রোনি ও বেসিউ এর মাঝামাঝি। একটা বিপদ মুহূর্তে তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সামিনও কৃতজ্ঞ। আমাকে যথেষ্ট সম্মানের সাথে বন্ধুত্বের আসনে বসিয়ে দিল; যদিও পরবর্তীতে আমার পেশাগত কারণে আমাকেই বরাবরের মত নিজেকে আড়ালে সরাতে হলো। তার আগেই সামিন আমাকে জানাল তার ব্যক্তিগত পরিচয়সহ স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা সব। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম সেদিন, যেদিন জানলাম প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়া সত্তেও সে পরিচয়হীন বাউ-ুলে। তবে, ইনডুনা নামের এক মেয়ে তাকে জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। একমাত্র তার জন্যই সে বেঁচে আছে এই পৃথিবীতে; না হয় সেই কবেই আতœহত্যা করে পরিচয়হীন জীবনটাকে শেষ করে দিত। কিন্তু যেদিন থেকে ইনডুনা এসেছে তার জীবনে সেদিন থেকেই তার সব আশা, ভালোবাসা, স্বপ্ন সব ঐ মেয়েটাকে ঘিরেই রচিত হচ্ছে। তবে, আমার র্দূভাগ্য ছিল সে সময় ইনডুনা থাইল্যা- থাকায় আমার সাথে তার দেখা হয়নি।
আজ আমি এ কোন সামিনকে দেখছি। সেই সামিন আর এই সামিনের মাঝে যেন আকাশ পাতাল ব্যবধান। আতœপ্রত্যয়ে ভরা সামিন আজ যেন ভাঙা একটা কাঠামো। তবে যা ভেবে অবাক হলাম তা হল- সামিন এখানে এই অরণ্যের মাঝে এভাবে কেন? সে খস খসে কন্ঠে জানতে চাইল- আমার সাথে যে মেয়েটা ছিল তার সাথে আমার কি সম্পর্ক? এখানে অনেক বিষয় জড়িত থাকায় মিথ্যের আশ্রয় নিতে হল। জানালাম- সে আমার প্রেমিকা।
যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে এমন স্বরে সে আমাকে জিজ্ঞাস করল- ইনডুনা কোথায়? প্রশ্নটা শুনে প্রথম আমার মনে হলো সামিন পাগল হয়ে গেছে। তবে পরমুহূর্তে সে যা জানাল, আমি এলোমেলো হয়ে গেলাম। আমার সাথে যে মেয়েটা ছিল, মানে নীরাই হলো সামিনের সেই স্বপ্ন ইনডুনা! একটা প্রতারক। সামিনের আশা, ভালোবাসা, সহায় সম্বল সব আতœস্যাৎ করে মায়ানমার থেকে পালায় মেয়েটা। এমনকি যাওয়ার সময় বুকে একটা গুলি করতেও ভুল করেনি। কিন্তু ভাগ্য সহায় থাকায় সামিন বেচে যায়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে নিজের সাথে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পৃথিবীময় খুঁজবে সে ইনডুনাকে শুধু মাত্র প্রতিশোধ নিতে। অনেক প্রচেষ্টায় সে ইনডুনার সন্ধান পায় এবং ঘন্টা খানেক আগে তার প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয় একমাত্র আমার কারণে।
সামিন জানাল, নীরা হয়তো তাকে দেখে ফেলে একটু আগে। তাই পালিয়েছে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দোলতে লাগলাম। এমন সময় সামিন জানতে চাইল, ইনডুনার কোনো স্মৃতি আছে কিনা আমার কাছে? সে এখনো ইনডুনাকে ভালোবাসে। মেয়েটা তাকে এতটাই প্রতারিত করে যে একটা স্মৃতি পর্যন্ত রেখে আসেনি। নীরার ট্রাভেল ব্যাগটা ছাড়া এখানে আর কিছু নেই। সামিন নিজেই ওটা তুলে নিল গাড়ির পিছনের সিট থেকে; এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই যেভাবে এসেছিল সেভাবে ঢুকে গেল গহীন অরণ্যে। আমার শূণ্য মাথায় কেমন যেন ঝিম মারা অনুভূতি হতে লাগল।
সামিনের কী হবে? যদি ধরা পড়ে, অবৈধ প্রবেশের জন্য জেল হবে। নাকি গহীন অরণ্যকে হার মানিয়ে এই বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে মায়ানমার পৌঁছাবে? নাকি অরণ্যের ভিতরেই চিরতরে হারিয়ে যাবে? এ ভাবনাগুলোকে চাপা দিয়ে হঠাৎ মাথায় গেল বিষয়টা। সামিন মরতে যাচ্ছে। দৌড়ে গেলাম সামিন যে দিকে গেছে সেদিকে। পশুদের চলার একটা পথ পাহাড় চূড়ার দিকে গেছে। উঠে এলাম চূড়ায়। দেখলাম অনেক নিচে একটা পাথরে পড়ে আছে সামিনের রক্তাক্ত দেহ। কিন্তু ওখানে থাকতেই নীরা নামের মেয়েটার জন্য কেমন যেন একটা শূণ্য অনুভূতি হলো। তবে কি আবারও কেউ ছুঁয়ে ছিল আমার মন?
পরবর্তীতে অবশ্য আসল নীরাকে উদ্ধার করা হয়েছিল রাঙ্গামাটির একদম উত্তর সীমান্তের বিটলিং ও বাংরাং এর মাঝামাঝি জায়গা থেকে। মূল ঘটনা প্রকাশ হলো। নীরাকে কিডন্যাপ করে তার জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল বহুরূপী ইনডুনাকে। সম্ভবত সে ঐ পোচার চক্রের সাথে জড়িত ছিল অথবা টাকায় বিক্রি হয়েছিল। ভাবতেই আমার মেরুদ- বেয়ে শীতল অনুভূতি বয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই এসব ক্ষেত্রে আমার সংগ্রহীত তথ্য লুকিয়ে ফেলে আমার মগজে একটা উত্তপ্ত সীসা ঢুকিয়ে দেওয়ার নির্দেশ ছিল ইনডুনার জন্য। কিন্তু সে তেমন কিছুই করলো না। তবে কি তাকেও প্রকৃত ভালোবাসা ছুঁয়ে ছিল? যদি সামিন না আসত তবে হয়তো এর উত্তর জানতাম।
ওহাইকং থেকে দু’দিন পর ইনডুনার লাশ উদ্ধার করেছিল হইওয়ে পুলিশ। বিষে নীল হয়ে ছিল তার সমস্ত শরীর। আমি দেখতে গিয়েছিলাম তার মৃতদেহ। আবারও একটা চাপা কষ্ট উপহার দিল জাগতিক এই কুহকিনী। ভেবে পাই না, কেন যে এরা আসে আমাকে পোড়াতে? কেন যে এসে টোকা দেয় আমার রক্তাক্ত হৃদয়ে?