ভূতেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে চলাচল করতে সক্ষম এমন কিছুকথা শৈশব থেকে শুনে আসছি, তবে তেমন এক অভিজ্ঞতার ফলে দেখারও সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। ১৯৯৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে রাত তিনটার দিকে উঠেছি তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতে। তখন ওই সময়টাতে উঠলেই বেশভালো মতো চুপচাপ তাহাজ্জুদ শেষকরে তাসবিহ করতে করতেই ফজরের আজান হতো। একই সাথে ফজরের ‘আস সালাতু খাইরুম মিনান নাউম’(সালাত ঘুমের চেয়ে উত্তম কাজ) শুনে ফজরের হাজিরার সিজদা করে একটু গড়াতে যেতাম বিছানায় বিশ্রামের জন্য। এমন অভ্যাস আমার বহুদিনের, সেইমতো ঘুমথেকে উঠে ওয়াশ রুমের দিকে যাচ্ছি ওজু করতে।
এমন সময় দেখি বেডরুমের দরজায় যে পর্দা তার ফাঁক দিয়ে ড্রইং বরাবর বিরক্তিকর কালো বিড়াল দাঁড়ানো আমার দিকে চেয়ে। এ এমন নতুন কিছুই নয়। ওকে দিনে দুইবার আমি এবং বাড়ীর সবাই ধাওয়া করি । এই বিড়াল তাড়া করবার পিছনে কষ্টের একটা কারণও আছে।
একদিন আমার শরীরটা খারাপ ছিলো রান্না করতেও কষ্ট হচ্ছিলো, শরীরে জ্বরজ্বর ভাব। বাচ্চাকে স্কুলে আনতে গেছে ওর বাবা। আমি কোনমতে ভাত ফুলকপি আলু ভাজি আর একটা ইলিশ মাছ পুরো রান্না করেছি দুইবেলা খাবার জন্য। রান্না শেষে হাঁড়িটা নামিয়ে রেখে হাত ধুতে গেছি বেড রুমের ওয়াশরুমে । এসে দেখি বিড়ালটা ঢাকনি ফেলে হাঁড়িতে মুখ ঢুকিয়ে ইলিশ মাছ খাচ্ছে।
এ দৃশ্য দেখে আমার কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। এরকমের ওই পাজী নচ্ছার বিড়াল টা পাশের বাসার সানশেড থেকে লাফিয়ে আমাদের দোতলার সানশেডে আসে, তারপর ঢুঁকে পড়ে জানালার গ্রীল এর ফোঁকর দিয়ে আমাদের বাসায়।
এই কালো বিড়ালটাকে বাসার সবার পছন্দ না করার আরো একটা কারণ আছে। আমাদের সোফার কাভার মেরুণ রঙের , প্রায় রাতে বিড়ালটা লুকিয়ে এসে আয়েশ করে সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে থাকে। সকালে বিড়ালটা উঠে গেলে অনেক থোকা থোকা লোম পড়ে থাকে যা পরিস্কার দেখা যায়। আমার বাচ্চারা সোফায় বসে যখন টিভি দেখে তখন বিস্কুট, চিপস খায়। ওগুলো সোফায় পড়লে অনেক সময় পড়াটাও তুলে মুখে ঢুকায়! আমি এই ভয়ে থাকি শেষে কোন অসুখ বিসুখ না বাঁধে ওই লোমগুলো পেটে গেলে। যেহেতু ওটা রাস্তার টোকাই বিড়াল, কেউ গোসল টোসলও তো করায় না, কাজেই সারা গায়ে ওর নোংরা মাখা থাকে। এই জন্য ওই বিড়ালটাকে আমি বেশ অপছন্দ করি।
যদিও আমার শৈশব, কৈশোরে আমি অনেক বিড়ালের লালন পালন করেছি, তারা ছিলো সুন্দর পরিষ্কার ভদ্র বিড়াল, তাদের নিয়মিত গোসল করানো, গা আঁচড়ে পোকা ফেলে দেয়া ইত্যাদি করে সুস্থ ও সুন্দর করে রাখতাম। যাদের সাথে নিয়ে ঘুমানোও যায় নিশ্চিন্তে।
যাহোক, এখনের কথায় আবার ফিরছি। আমি অজু করতে যাবো খাটের ডান দিক থেকে নেমে সেটা ডিঙ্গিয়ে সাত আট ফুট হেঁটে যেতে হয়। ঘরের বাম দিকের দরজার পাশে ওয়াশরুমে যাওয়ার মাঝখানে হঠাত বিড়ালটা এসে দাঁড়ায়, ক্যামন বীভৎস হলুদ চকচকে চোখে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সে। সেই পাজী কালো বিড়াল। আমি ওর দিকে ভালো করে তাকাতেই দেখি হঠাৎ তার আঁকার আয়তনে বেড়ে একটা বাঘের মতো বড় হয়ে গেছে । আন্দাজ প্রায় ছয় – সাত ফুট দেখাচ্ছে নিমিষের ভিতরেই। আমি এই মুহূর্তে স্পষ্ট বুঝে ফেলি এ হচ্ছে সেই অপশক্তি, যার নাম সবাই জানে, সে হচ্ছে একটা ‘শয়তান’।
সাথে সাথে “আয়ুজুবিল্লাহ হিমিনাশ শায়তান নিররাজিম’’ পাঠ করি। বিড়ালটা আমাকে ধাক্কা মারে থাবাদিয়ে, মাটিতে ফেলে দুই থাবা দিয়ে গলা টিপে ধরতে যায়। সেই মুহূর্তে আমি আল্লাহ্ কাছে আশ্রয় চাই। মনে মনে বলি আশ্রয় দাও এই বিতাড়িত শয়তান থেকে আমার মালিক, আমাকে রক্ষা করো। সাথে সাথে আমার শরীরটাও হঠাৎ বড় হতে থাকে, হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি এক দেড় ফুট মতো আমার হাতের তালু হয়ে গেছে। শরীরেও প্রবল শক্তি ধারণ করছি এ মুহূর্তে এটাও অনুভব করতে পারছি স্পষ্ট করেই।
আমি প্রতি দমে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্ললাহ’ বলছি এবং কালো বিড়ালকে উল্টিয়ে মাটিতে ফেলে তার শরীরের উপরে চড়ে বসেছি দুইপাশে দুই পা’ দিয়ে। আমার দুইহাত দিয়ে বিরাট বিড়ালের গলার উপরে এক হাত গলার নীচে আরেক হাত দিয়ে মোচড় দিতে চাচ্ছি আর মুখে বলছি, উনি গাফুরুর রাহীম ‘তাই তোকে ছেড়ে দিয়েছেন। আজ আমি তোকে নির্ঘাত মেরে ফেলবো বিতাড়িত শয়তান!
হটাৎ আমাকে হাঁটুর উপর ফেলে উধাও হয়ে যায় কালো বিড়াল রুপি ভুতের বাচ্চা! তারপর আমি উঠে দোয়া পড়তে পড়তে অজু করতে যাই। দাঁত ব্রাশ করার সময় চোয়ালে ব্যথা পাই যেখানে সে চেপে ধরেছিলো। ভালো করে দোয়া পড়ে স্থিরভাবে অজু করে ঘরে ফিরে আসি। জায়নামাজ বিছিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়াই। এক রাকাত সালাত আদায় করার সময় অর্থাৎ দুই সিজদা দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই পিছনে ক্যামন যেনো অদ্ভূত ‘চিও পিঁও’ এ জাতীয় অচেনা শব্দ শুনতে পাই।
মনে মনে ভাবি এটাও শয়তান ওই ভুতের বাচ্চাটার কান্ড। নইলে এমন শব্দে বাড়ীর আর কেউ তো জাগছে না ? গভীর মনোনিবেশ করে ভাবতে থাকি, ভূমিকম্প হয়ে মাটি দুই খন্ড না হওয়া পর্যন্ত সালাত অর্থাৎ নামাজ ছাড়ছিনা, সালাম না ফিরানো পর্যন্ত। সালাম ফিরাবার পর দেখি বিকট কিসের দুর্গন্ধ আসছে, তাতেও মন সংযোগ না ছেড়ে আরো চার রাকাত নামাজ শেষকরে উঠে এসে দেখি যেই খাটে আমার বাচ্চা আর হাজবেন্ড শুয়ে আছেন সেটার এক কোনায় আগুন জ্বলছে। এবার ঘরে টেবিল লাইটের শেডদেয়া লাইট, যেটা রাতে বই পড়ার কাজে ব্যবহার করি যাতে কারো চোখে সরাসরি আলো না লাগে, সেই আলোটা জ্বালি। পায়ের নিচের মোটা পা’ মোছা পাপোষ বা ম্যাট’ দিয়ে আগুন চেপে ধরি, চেপে ধরাতে সেটা নিভে যায়। পরপর ঘরের সবগুলো কানেক্টর, মাল্টিপ্লাগ খুলে ফেলি একে একে। পোড়া জায়গাটা ছোট্ট একটা ফেস টাওয়েল দিয়ে ঢেকে দিই। ক্যামন ফোঁড়ার মতো কালো উঁচু হয়ে আছে খাটের কোণার কাঠ পুড়ে যেয়ে।
সেদিন আর কিছু বলিনি হাজবেন্ডকে। ও বেশ ভিতু টাইপের, ভুতের ভয় পায়। বললে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে এই ভেবে চুপ করে থাকি। সবাই বেরিয়ে গেলে ধারালো ছুরি দিয়ে চেছে কালো পোড়াটা সমান করার চেষ্টা করি। বড় ছেলের তখন ছয় বছর বয়স ছিলো। ছেলে জিজ্ঞাসা করে পুড়লো কি করে আম্মি? আমি বলি, ভুতে পুড়িয়েছে গতরাতে। বিকেলে ওর বাবা বাড়ী এলে ছেলে বাবার কাছে কথাটা বলে দেয় এবং রুমাল সরিয়ে পোড়া জায়গাটা দেখায় ওর বাবাকে।
এরপর আমিও অতোটা গভীর না করে হাল্কা করে ঘটনাটা বলার চেষ্টা করি। ও শুনে তো তখনই লোক ডেকে এনে খাটটি বিক্রি করে দেয় পুরোনো ফার্নিচারের দোকানে। তার দুই দিন পর আবার নতুন খাট কিনে আনে। কালো বিড়ালটাকে সেদিন সেই রাতের ভয়াবহ ঘটনার পরে আর আমাদের বাড়ীতে আসতে দেখিনি। কি কারণে অমন করে বিড়াল বিরাট হয়ে আমাকে আক্রমণ করেছিলো ? আর আমিই বা কি করে ওর চেয়েও বড় এক ‘সুমো’ কুস্তীগির পালোয়ানের মতো শক্তিশালী হয়ে গিয়েছিলাম! তা আজও বুঝতে পারিনি।
তবে এটা বলতে পারি, সাহস অনেক বেশী দৃঢ় হয়েছে আত্মিকভাবে। এমনিতেই খুব ভিতু কখোনোই আমি ছিলাম না । বিশেষ করে ভুত প্রেতে তেমন বিশ্বাস কিংবা ভয় করতাম না। সেদিন কিছুটা ভড়কে গেলেও এখন পুরোদমে সাহসী করে তুলেছে সেই রাতের ঘটনা। বোধ হয় এই সাহসটাকে আত্মবিশ্বাসও বলা চলে। এমন আত্মবিশ্বাস গঠন করলে কোন ধরণেই ভয়ই কাউকে কাবু করতে পারবেনা, এমনটাই সবার আশা করা উচিত।