তালেবান নিয়ে ভারতের আতঙ্কের কারণ

আনিস আলমগীর:
২০০১ সালে আফগান-আমেরিকান যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ করার ঠিক এক বছর পর যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান দেখার জন্য আমি যখন আবার কাবুল যাই, সেখানে পড়তে হয় ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে। ইসলামাবাদ থেকে আরিয়ানা নামের ছোট্ট একটি উড়োজাহাজে কাবুলে পৌঁছার দ্বিতীয় দিনে কাবুলের কেন্দ্রস্থলে একটি জনবহুল রাস্তায় আমাকে আটক করে কিছু লোক। তারা সবাই তালেবানের প্রতিপক্ষ- নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সমর্থক। ক্ষমতা বদলের পর হামিদ কারজাই শাসনামলে তারাই তখন কাবুলের পাহারাদার। যুদ্ধকালে আমি কান্দাহারে তালেবানের হাতে বন্দি হয়েছিলাম আমেরিকার গোয়েন্দা সন্দেহে, এ অভিজ্ঞতা ছিল তার বিপরীত।
তারা বলছে আমি পাকিস্তানি, কাবুলে কেন আসলাম। উর্দুতে কথা বলছিল। আমি কথাবার্তা চালানোর মতো হিন্দি-উর্দু মিশ্রিত একটা খিচুড়ি ভাষা জানি, কিন্তু ভুলেও তা বলছিলাম না তখন। কারণ ইসলামাবাদ থেকে সাংবাদিক বন্ধুরা আমাকে সতর্ক করেছিল যে, কাবুলে পাকিস্তানি কাউকে পেলে লাঞ্ছিত করে ওরা। উর্দু বলা মানেই পাকিস্তানি সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হওয়া। কেউ কেউ প্রশ্ন করছে- হিন্দি, হিন্দি? মানে আমি ভারতীয় কিনা, ভারতীয় হলে ওরা ছেড়ে দেবে। আমি সঙ্গে থাকা পাসপোর্ট দেখালাম, মূর্খরা তা চিনে না, পড়তেও পারে না। অনেক কষ্টে তাদের রাজি করাতে পারলাম যে নিকটস্থ কোনো পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাও আমাকে। তাই করলো এবং পুলিশ আমার পরিচয় পেয়ে সম্মানের সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছিল।
এই কাহিনি বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে তালেবান পতনের পর আফিগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর দখলদারির ভারতীয়দের আধিপত্য বোঝানো। আফগান যুদ্ধে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ নামকাওয়াস্তে তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে থাকলেও যুদ্ধের পর পাকিস্তান হয়ে যায় আফগান সরকারের শত্রু রাষ্ট্র, ভারত হয় মিত্র রাষ্ট্র। সোভিয়েত যুগের মতো ভারতঘেঁষা কাবুল সরকারের সহায়তা পেয়ে ভারত সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যে আধিপত্য গড়ে তোলে এবং পাকিস্তানবিরোধী একটা পরিবেশ তৈরি করে, যা পরবর্তী দুই যুগ ছিল বলা যায়।
হামিদ কারজাই থেকে শুরু করে আশরাফ গানি, কারও সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত ছিল না, কারণ আফগান সরকারের ওপর ভারতের প্রভাব। এমনকি ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান অভিযোগ করেছিল যে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীদের আন্দোলনে উসকানি দিতে ভারত আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করছে।
পাকিস্তানের অব্যাহত সহায়তায় এখন তালেবান পুনরায় কাবুল জয় করেছে। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই কাবুলে ভারতের কূটনীতি ব্যর্থ হওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। আমি নিজেও গত বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তায় ভারতের আকাঙ্ক্ষা যে আফগানিস্তানে হতাশায় পরিণত হবে আর সেখানে চীন-পাকিস্তানের উপস্থিতি ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের উচ্চাভিলাষকে আরও এক ঝাঁকুনির মুখে ফেলে দিচ্ছে- সে আভাস দিয়ে দুটি কলাম লিখেছিলাম।
২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবানের সঙ্গে আমেরিকার চুক্তির পর এটা স্পষ্ট ছিল যে, সময়ের ব্যবধানে তালেবান নেতৃত্ব বিশ্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে আফগানিস্তানের উন্নয়ন, গঠন এবং শান্তি প্রক্রিয়ায় তাদের বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। প্রতিবেশী ইরান, চীন, রাশিয়া, সেন্ট্রাল এশিয়ার দেশগুলো, পাকিস্তান সবাই একমত যে জাতি গঠনে তালেবানদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা রয়েছে। এটাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
সেক্ষেত্রে ভারতের কূটনীতি ও ভূমিকা চরম ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা তালেবানবিরোধী অবস্থানে আমেরিকা-রাশিয়া কাউকেই পাশে পায়নি। তালেবানের সঙ্গে ২০১৬ সাল থেকে যখন আমেরিকানদের আলোচনা শুরু হয় ভারত সেখানে কোনো পাত্তাই পায়নি, যদিও দক্ষিণ এশিয়ায় সে আমেরিকান স্বার্থের পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে আসছে। মাঝখানে চীনের সরাসরি হন্তক্ষেপে তালেবান শীর্ষ নেতৃত্ব পাকিস্তানের সঙ্গে প্রকাশ্য আলাপ শুরু করে। কাবুল সরকার, তালেবান আর পাকিস্তানকে একমঞ্চে আনতে চীন নেপথ্য ভূমিকা রাখে।
গত বছরের ২৬ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি আফগানিস্তানে নিয়োজিত চীনের বিশেষ দূত লিউ জিয়ানকে আফগানিস্তানের যুদ্ধ শেষ করতে সাহায্য করার জন্য ইসলামাবাদে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে কীভাবে তালেবান এবং আফগান সরকার একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে তার রূপরেখা নিয়ে তালেবানদের রাজনৈতিক শাখার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বৈঠক হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুরেশির সঙ্গে তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গণি বরাদরের নেতৃত্বে একটি তালেবান প্রতিনিধি দল আলোচনা করে। বৈঠকে আইএসআই প্রধানও উপস্থিত ছিলেন।
আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের সিংহভাগ হতো পাকিস্তানের মধ্য দিয়েই। স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানের বেশিরভাগ বর্হি-বাণিজ্যও হয় পাকিস্তানি সমুদ্র বন্দর দিয়ে। কিন্তু পাকিস্তানের আপত্তির কারণে নানা সময় আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতীয় পণ্য রপ্তানি বন্ধ রাখতে হয়। কাজেই বিকল্প রুট হিসেবে ভারত ইরানের চাবাহার সমুদ্র বন্দর ব্যহারের কথা ভাবে। অর্থাৎ ইরানের চাবাহারকে গেটওয়ে বানিয়ে শুধু আফগানিস্তানের সঙ্গে নয়, তুর্কমেনিস্তানসহ পুরো মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চায় ভারত।
ইরানের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য ভারত ত্রিপাক্ষিক ট্রানজিট চুক্তিও করে। চাবাহার বন্দর উন্নয়নের জন্য ভারত ইরানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে। সেই অনুযায়ী ভারত সমুদ্র বন্দরটির উন্নয়নে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। কারণ চাবাহার বন্দর ভারত থেকে পাঠানো ভারী মালপত্র হ্যান্ডেল করার উপযুক্ত নয়। চুক্তি অনুসারে ইরান তৈরি করে দেবে চাবাহার বন্দর থেকে আফগান সীমান্ত পর্যন্ত হাইওয়ে। আফগান সীমান্ত থেকে ভেতরের দিকে ২০০ কিলোমিটার সড়ক তৈরির দায়িত্ব ভারতের। সেই সড়ক নির্মাণকালে তালেবানের হাতে মারা গেছে বহু ভারতীয় নির্মাণ কর্মী।
চাবাহার পোর্ট এবং পোর্ট সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য ইরান ২০২১ সালের ২৭ মার্চ চীনের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করে। সেটি আবার হতাশ করে ভারতকে, যদিও তারা চাবাহারে বিনিয়োগ করছে ধীরগতিতে।
তালেবানের ক্ষমতা দখলে ভারতীয় মিডিয়া এবং সরকারের উৎকণ্ঠা চোখে পড়ার মতো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদি রাশিয়া, জার্মানিসহ বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন। ভারত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের চলতি মেয়াদে সভাপতি থাকায় আফগান পরিস্থিতি নিয়ে পরিষদের বিশেষ বৈঠকও ডেকেছিল। এমনকি তালেবানদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগেরও চেষ্টা করছে ভারত। তালেবান ক্ষমতায় আসায় বেহাল অবস্থায় পড়েছে নয়াদিল্লি। তাদের আশঙ্কা, তালেবান সরকার বাধা দিলে আফগানিস্তানে তাদের এতোদিনের শ্রম এবং চাবাহার বন্দরে পুরো বিনিয়োগ জলে যাবে।
ভারতের জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের বিষয় হতে পারে তা হরো উপমহাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সম্ভাব্য বৃদ্ধি। বিশেষ করে কাশ্মিরে ভারত যেভাবে মানবাধিকার লংঘন করছে এবং কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়েছে তার পরিণতি নিয়ে। তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে কাশ্মিরে আরও গোলযোগের সম্ভাবনা বেড়ে গেছে, যদিও তালেবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের মাটি কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হবে না। কিন্তু কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলন তালেবানের চোখে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কি না বড় প্রশ্ন হয়ে আছে।
ভারত নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জড়িত লোকদের ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৮১৪ নম্বর এয়ারবাস ছিনতাইয়ের ঘটনা। বিভিন্ন শহর ঘুরিয়ে অবশেষে কান্দাহার এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করানো হয়েছিল সেই উড়োজাহাজ। কাশ্মির আন্দোলনে জড়িত ভারতের জেলে বন্দি তিন নেতা মুশতাক আহমেদ জারগার, আহমদ ওমর সাঈদ শেখ এবং মাসুদ আজহারকে মুক্তির বিনিময়ে যাত্রীদের উদ্ধার করতে আলোচক হিসেবে ওই সময় কান্দাহারে যাওয়া ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের স্মৃতিতে তো এখনো তাজা হয়ে থাকার কথা সেই ঘটনা। তখনো আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিল তালেবান। ফলে তালেবান যখন রাজনৈতিক বৈধতা লাভ করেছে তখন আগে থেকেই কাশ্মিরে সক্রিয় হাক্কানি নেটওয়ার্ক, লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জৈশ-ই-মোহাম্মদের মতো গোষ্ঠীর হুমকি বেড়ে যাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণ প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলবে। উভয় দেশই তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী, যেখানে ভারত এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং তালেবানের প্রতিপক্ষকে তার মাটিতে আশ্রয় দিয়ে আসছে। আবার চীন-পাকিস্তানকে উপক্ষো করে তালেবান সরকার ভারতের সঙ্গে এই মুহূর্তে মধুর সম্পর্কে যাবে না, এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। শেষ পর্যন্ত ভারত এ কূটনৈতিক বিপর্যয় কীভাবে কাটিয়ে উঠবে আগাম বলা যাচ্ছে না। তবে তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক করা ছাড়া তাদের যে পথ খোলা নেই সে ব্যাপারে কারও সন্দেহ নেই।

অন্যধারা/ ২৬ আগস্ট, ২০২১/ দ ম দ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here