দুর্ঘটনা । আলী মুহাম্মদ লিয়াকত

- Advertisement -
- Advertisement -

সে অনেক দিন আগের কথা, আজ থেকে কমপক্ষে ত্রিশ বছর আগের কথা। তবে মানুষের বিশেষ করে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা বদলেছে বলে মনে হয় না। হয়তোবা আরো খারাপ হয়ে থাকবে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীতো ক্রমাগত ভাবে নিম্নগামীই হচ্ছে। তাই বাস্তব পেক্ষাপট আজও বদলায়নি মনে করেই এক সত্য ঘটনাকে গল্পাকারে লেখা।

আসলে এটা কোন ঘটনা নয়। ছিল একটি দুর্ঘটনা। আমি তখন সংসদ ভবনে চাকুরী করি। অফিস শেষে এক বন্ধুকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চন্দ্রিমা উদ্যানের কাছাকাছি এসে গেছি। হঠাৎ একটুখানি সামনের দিকে রাস্তার উপরে দেখি শ’খানেক লোকের ভিড়। সবাই প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছিল।

হঠাৎ আমার মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল। বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম- বল তো দেখি ঐ সামনে রাস্তার উপর ওখানে কি হয়েছে? বন্ধু বললো, কি আর হবে, দেখে তো মনে হচ্ছে মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। হয়তোবা একাধিক লোক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। আর পথচারী মানুষেরা তাই দেখে মর্মবেদনা প্রকাশ করছে। হয়তোবা কেউ মারাও যেতে পারে। আমার আইডিয়াটা চক্কর মেরে বললো, আয় আমার সাথে বাজি ধর। ঐ জাতীয় মারাত্মক কিছুই ঘটেনি ওখানে। বন্ধু অবাক হয়ে বললো- তুই বলিস কি? মারাত্মক কিছু না ঘটলে ঐ রকম বিশাল লোক সমাগম হয় নাকি? আমি বললাম-না তা হবে না। মারাত্মক কিছু ঘটলে এতলোক এতক্ষণ ধরে আশে পাশে বা কাছে আসতোই না। বরং চাচা আপন জান বাঁচা বলে তড়িঘড়ি করে ওখান থেকে সরে যেত। বন্ধু পাল্টা প্রশ্ন করলো- বললো- তাহলে কি হয়েছে বলে তোর মনে হয়। আমি আমতা আমতা করে বললাম নিশ্চয়ই মেয়ে ঘটিত কোন দুর্ঘটনা হয়ে থাকবে। বাজি ধর আমার সাথে- মাত্র একশত টাকা। ও রাজি হল।

আমরা দু’জনে সামনে হেঁটে ঘটনাস্থলে এসে দেখি আমি যা অনুমান করেছি, ঠিক তাই। একটা মেয়ে রিক্সা থেকে ধাক্কা লেগে পড়ে গেছে। তার কাপড়-চোপড় কিছুটা এলোমেলো অবিন্যস্ত হয়ে গেছে। মেয়েটা কলেজে পড়া মেয়ে বলে মনে হলো। মেয়েটা অনেক সুন্দরী। শুধু সুন্দরী বললে ভুল হবে। মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী। মেয়েটা কোমরে বা পায়ে ব্যথা পেয়েছে তাই মনে হয়, উঠতে পারছে না। এত লোক ভিড় করছে অথচ কেউ তাকে উঠতে সাহায্য করছে না। বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা করে দেখছে। তার পায়ের কাপড় কতটা উপরে সরে গেছে। তার কোমরের কত অংশ দৃশ্যমান, তার বক্ষ কতটুকু উচু, তার মুখশ্রী কতটা সুন্দর। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় উপস্থিত দর্শকবৃন্দ হাভাতে চোখ গুলো দিয়ে মেয়েটার শারীরিক সৌন্দর্য গোগ্রাসে গিলছে। দু’এক জন শান্তনার সুরে আহা উহু করে বলছে, আহ্- কিভাবে যে মেয়েটা পড়ে গেল। ব্যস এটুকুই। কেউ তাকে উঠানোর বা হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করছে না।

আমার একনজর দেখে মনে হলো মেয়েটা কোন সম্ভ্রান্ত বংশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হতে পারে। উপস্থিত জনতার কাছে প্রশ্ন করে জানা গেল যে একটা বেবি টেক্সী রিকসাটাকে ধাক্কা লাগিয়ে পালিয়ে গেছে। মেয়েটা রিক্সা থেকে ছিটকে মাটিতে পড়েছে। পড়েছে তো পড়েই আছে। নিজের শক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারছেনা। সম্ভবত কোমরে একটু বেশি চোট বা আঘাত লেগেছে।

এইখানে একটু অপ্রয়োজনীয়, তবে বাস্তব কথা বলছি। সাধারনত এমনটাই হয়। সুন্দরী যুবতীদের দেখতে পেলে অনেকেই একটু গা ঘেসে চলে যায়। আর রিকসাওয়ালা বা বেবিটেক্সীওয়ালারা পারলে একটু ধাক্কা মেরে আনন্দ পায়। হায়রে মানুষ, হায়রে দেশ।
আজও এই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়নি। বরং কূ-দৃষ্টির প্রভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আর তাইতো হামেশা পত্রপত্রিকায় দেখা যায় যে, তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে নারী নির্যাতন, নারী উৎপীড়ন, নারী ধর্ষণের মতো ঘটনা বেশ ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। সেখানে থাকে একজাতীয় ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি। পত্রিকার কাটতি/বিক্রয় বাড়ানোর জন্য কৌশলী প্রচেষ্টা। কবে যে সমাজ বদলাবে। মানুষের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর উন্নতি ঘটবে।

যা হোক, ধান বানতে শীবের গীত অনেক গাওয়া হয়ে গেল। আমাদের মনে হয় সম্বিত ফিরে এলো। আমরা দু জনে তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সি ক্যাব ডেকে ওটাতে মেয়েটাকে উঠিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সেখানে যেয়েও দেখি অব্যবস্থা। নার্সদের কে অনেকবার অনুরোধ করে মেয়েটাকে একটা ষ্ট্রেচারে শোয়ানো হলো। ট্রলির উপর মেয়েটাকে রেখেই হন্তদন্ত ভাব দেখিয়ে নার্স চলে গেল। ১৫/২০ মিনিট হয়ে গেল কোন নার্স বা ডাক্তার আসছে না। মেয়েটার করুণ দৃষ্টি দেখে হতচকিত হয়ে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের রুমে গেলাম। সব ঘটনা খুলে বলে ডাক্তারকে অনুরোধ করলাম একটু তাড়াতাড়ি করে মেয়েটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য। ঢিমেতালে ডাক্তার এসে মেয়েটাকে দেখলো এবং কি ভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে শুনে বললো কমপক্ষে ২টি এক্সরে করতে হবে। কোমরের এবং হাঁটুর। টেষ্ট ফি জমা দিতে হবে। আমাদের পরিচয় জেনে বললো মেয়েটার বাবা-মা বা অভিভাবকদের খবর দিন।

ঐ আমলে বর্তমানের মতো মোবাইল ফোনের এত প্রচলন ছিলনা। উচ্চ বিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারে ল্যান্ড ফোনের ব্যবহার করা হত। অফিস আদালতেও ল্যান্ড ফোনের প্রচলন ছিল। মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলাম- তাদের বাসায় ল্যান্ড ফোন আছে কিনা? মেয়েটা একটা নাম্বার দিল, নাম্বারটা মেয়ের বড় ভাইয়ের অফিসের। যোগাযোগ করে তার বড় ভাইকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম ও যথাশীঘ্র সম্ভব পঙ্গু হাসপতালে আউটডোরে এসে বোনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার কথা বললাম।

কিছুক্ষন পর মেয়েটার বড় ভাই এলো। তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমরা হাফ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি এমন সময় মেয়েটা আমাদের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো এবং বাসার ঠিকানা দিয়ে বললো কাল পরশু পারলে একবার আমাকে দেখতে এলে খুশি হবো। না- আমরা মেয়েটাকে খুশি করার করার জন্য বা তার বাসায় এক বেলা চা-নাস্তা খেতে যাইনি। আসল কারণটা কি জানেন? আসলে আমরা কেউই ঐ সময়ে আর অবিবাহিত ছিলাম না। কাজেই যাওয়ার উৎসাহে ঘাটতি ছিল। তাই নাটকের গল্প আর বেশীদূর এগুতে পারেনি। তবে বাজিতে জেতা একশত টাকা আমার আর নেওয়া হয়নি।

- Advertisement -

আরো পড়ুুর