নিশ্চিত করতে হবে শিশুর নিরাপত্তা

1455634777

শিশু অধিকার শব্দটা যখন আমাদের কানে আসে স্বভাবতই আমাদের সমস্ত চিন্তা চেতনা চলে যায় পথ শিশুদের দিকে।তারা বেড়ে ওঠার জন্য সুন্দর স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ পাচ্ছে না,পাচ্ছে না প্রয়োজনীয় খাবার।তার উপর আরো কঠিন হয়ে পড়ছে শিক্ষা সুবিধা পাওয়া ।কোন কোন জেলাতে প্রাইমারী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ঘোষনা করার পরো দেখা যাচ্ছে শিশুরা পর্যাপ্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।এই চিত্রটি অনেক পুরনো।কিন্তু ইদানিং কালে অনেক বেশী মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে শিশু হত্যা বা শিশুদের উপর অকথ্য নির্যাতন।আর সেটা কেবল দরিদ্র পরিবারেই আটকে থাকাছে না ,ছড়িয়ে পরেছে বিত্তশালী পরিবারেও।

শিশুরা সুন্দরের প্রতীক, পবিত্রতার প্রতীক, নিসর্গ আনন্দের উৎস। প্রতিটি শিশুর নিরাপত্তা ও সঠিকভাবে গড়ে উঠার জন্য দরকার তার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর আদর-ভালবাসা-যথাযথ পরিচর্যা ও সঠিক দিক নির্দেশনা। এক কথায় একটা সুস্থ পরিবেশ ও নিরাপদ আশ্রয়।কিন্তু অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারে দেখা যায় একটি বাচ্চাকে বিশেষ করে যদি সে নারী হয় ,কাগজ কলমে বড় বানিয়ে গার্মেন্সে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথবা বিয়ে নামক কঠিন শৃংখলে আবদ্ধ করে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সুন্দর শৈশব।আর ছেলে সন্তানকে পয়সা উপার্জনের জন্যে বিভিন্ন কল-কারখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ বাচ্চারাই এখান থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে অনৈতিক কার্যকলাপে অতি অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করে ।

শিশু নির্যাতন আসলে সবার আড়ালে ঘটে বেশি ,তা ঘর-বাড়িতে অথবা অফিস -কারখানা সব জায়গাতেই।গৃহকর্ত্রী কর্তৃক গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের দৃশ্য এখন অনেকটা সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে । শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে দেওয়া , একটু ভুল করলেই গায়ে গরম পানি ঢেলে দেওয়া -এগুলো প্রায়শই সংবাদ পত্রে উঠে আসে।এই ধরনেরসংবাদ আমাদের সাময়িক বিচলিত করে ,কিন্তু সরকার বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান থেকে বলিষ্ঠ কোন পদক্ষেপ আজো নেওয়া হয়নি।কেবল কয়েকটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা হয়েছে মাত্র। গৃহকর্মী শিশুদের উপর এদের অত্যাচার অনেক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে শিশুটির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। শুধু তাই নয়। এই গৃহপরিচারিকা শিশুরা অনেক সময় গৃহকর্তার দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় এই যে, শিশু নির্যাতনকারী এসব পাষন্ডদের অধিকাংশই শিক্ষিত ও ভদ্র সমাজের বাসিন্দা।কেবল মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের বিরুদ্ধে আনিত মামলা নিমিষেই গুড়িয়ে ফেলছে আর অসহায় থাকছে শিশুটির পরিবার।এদের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাচ্ছে তা এখানে বিবেচনায় আসছে না কেউ ।

যে দেশে শিশু শ্রমকে পুরোপুরো নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে সেখানে আমরা শহরে-বন্দরে হোটেল-রেস্তোরা, কল-কারখান, গাড়ির গ্যারেজ, রেলওয়ে- সর্বত্র শিশু শ্রমিকদের একটা লক্ষণীয় উপস্থিতি দেখতে পাই। এদের অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত । দরিদ্র পরিবারে দু’মুঠো খাবার জোগারের দায়িত্ব এই বাচ্চাদের ঘাড়ে ,অথচ এদের অধিকাংশই সঠিক মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি কাজে সামান্যতম অবহেলা বা ভুল-ত্রুটির কারণে এই শিশুরা মালিকদের দ্বারা শারিরীক নির্যাতনেরও শিকার হয়ে থাকে। কিছু দিন আগেও পায়ূপথে গ্যাস দিয়ে একটি বাচ্চাকে মেরে ফেলার সংবাদ আমরা পেয়েছি।এমন অনেক নাম না জানা শিশুদের উপর মালিক বা নিয়োগকারীরা অত্যাচার চালিয়ে আসছে। কারণ ,তাদের কোন জবাবদিহিতা নাই।

শিশু নির্যাতনের একটি আধুনিক চিত্র-পারিবারিক কলহ।বাবা বা মা একে অন্যকে শায়েস্তা করার জন্য বাচ্চাদের উপর অত্যাচার চালায় অথবা মায়ের মানসিক অসুস্থতার শিকার হচ্ছে অনেক শিশু।এই ঘটনাগুলো বেশী ঘটছে উচ্চবিত্ত পরিবারে।পরকীয়ার জের ধরে শিশু অপহরণ , নিজের বাচ্চাকেসহ আত্মহত্যা -এই গুলোর হার এখন তীব্র ভাবে বেড়ে গেছে।

আবার অন্য দিকে শিশুদের নিয়ে শিক্ষিত বাবা মায়ের মধ্যে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতাও চলতে দেখা যায় ।সন্তানকে সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করতে হবে, নাচ-গান-আবৃত্তি-বিতর্ক-খেলাধূলা, সব বিষয়ে তুখোড় হতে হবে – মা-বাবার এই ধরনের মানসিকতার কারণে নিস্পেষিত হয় সন্তানরা। অথচ এটা যে এক ধরণের মানসিক নির্যাতন সেটা বাবা-মায়েরা কখনও ভেবে দেখেননা।সম্প্রতি ,পরীক্ষায় খারাপ করাতে কিছু বাচ্চা আত্মহত্যার পথো বেছে নিয়েছে বাবা মায়ের অত্যাচারের ভয়ে।বিষয়টি কোমলমতি বাচ্চাদের জন্য কতোটা ভয়াবহ তা ভেবে দেখবার বিষয়।বাবা মায়ের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সমান তালে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করেই যাচ্ছে।ফলশ্রুতিতে যে শিক্ষা শিশুদের জন্য হয়ে উঠতে পারতো আনন্দদায়ক, সেই শিক্ষা শিশুদের কাছে হয়ে উঠেছে ভীতিকর। স্কুলের পড়ার চাপে বাসায় ফিরে খেলাধূলা করে আনন্দ করে সময় কাটাবে সেই উপায় নেই শিশুদের , কারণ সেখানেও আছে বাবা-মায়ের খবরদারি আর প্রাইভেট শিক্ষকের পড়ানোর নামে চাপাচাপি । এ অবস্থায় শিশুদের সুকুমার বৃত্তিগুলো বিকশিত হবার কোন সুযোগ থাকে না। সম্প্রতি গোল্ডেন- এ প্লাস পাওয়া স্টুডেন্ডদের উপর একটি জরীপ চালিয়ে দেখা গেছে-খুব সাধারণ জ্ঞানের উত্তর তারা করতে পারেনি।তার মানে মুখস্থ বিদ্যা আর অতিরিক্ত সিলেবাসের বোঝা বইতে গিয়ে তারা নিজেদের স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধি টুকুও হারিয়ে ফেলেছে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপে বলা হয়, দেশে ৭৩ দশমিক ছয় শতাংশ শিশু বাবা-মার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়। সেখানে বলা হয় খাওয়াতে, পড়াতে আর শৃংখলা শেখাতে গিয়ে মা-বাবারা বেশি মারধর করে থাকেন।

বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ২৬৭টি সংগঠনের মোর্চা শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালে ২০৯, ২০১৩ সালে ২১৮, ২০১৪ সালে ৩৫০ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালে সেই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১৯১ জনে।বর্তমানে শিশুহত্যার প্রক্রিয়া বীভৎস থেকে বীভৎসতর হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ শহিদ মাহমুদ।

এই ধরণের ঘটনায় মামলা হলেও বিচার যে শেষ হচ্ছে, তার কোনো নজির দেখা যাচ্ছে না। ঘটনা ঘটার পর সরকারের পক্ষ থেকে হচ্ছে, দেখছি বা তদন্তাধীন আছে বলে সেটা সেখানেই থেমে থাকছে।অবশ্য গত বছর রাজন হত্যার সুরাহা করা গেছে,কিন্তু এমন আরো অনেক মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে।গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বাইরে হয়তো আরো ঘটনা ঘটছে, যেগুলো জানা যাচ্ছে না। আরো স্পর্শ কাতর বিষয় হচ্ছে অনেক নির্যাতনের বীভৎস ভিডিও এখন ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে যা বাচ্চাদের উপর ভয়াবহ মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।কিন্তু এই ব্যপারে বিটিআরসি তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ প্রচলিত আছে। এই আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি বিষাক্ত, দাহ্য বা দেহের ক্ষয় সাধনকারী কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটায় তবে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। উল্লিখিত বস্তু দ্বারা নারী বা শিশুর দেহে আঘাত করার ফলে যদি নারী বা পুরুষ চিরদিনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারায়, তার মাথা কিংবা মুখমন্ডল বিকৃত হয়ে যায়, শ্রবণশক্তি চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যায় অথবা দেহের কোন অঙ্গ বা গ্রন্থি স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তবে এর শাস্তি মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ন্যূনতম ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।

একই আইন এও বলা হয়েছে যে, নারী বা শিশুকে ধর্ষণের শাস্তি হবে অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড। অবৈধভাবে শিশু পাচার কিংবা হাজতে অথবা কারো কাছে কোন শিশুকে আটকে রাখলে তার শাস্তিও মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড। তাছাড়া শিশু অপহরণ কিংবা অন্যায়ভাবে কোন শিশুকে লুকিয়ে রাখার শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে।

মানুষের মাঝে অস্থিরতা -বিকৃত চিন্তা থেকে অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে শিশুদের সামাজিক অবস্থান।সুস্থ সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে চাইলে শিশুদেরকে একটি মুক্ত স্বাধীন বিশ্বস্ত পরিবেশে বাড়তে দিতে হবে।পাঠ্যবইয়ের পড়াশোনা হতে হবে অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব যেন শিশু আলাদা কোন চাপ অনুভব না করে।দরিদ্র পরিবার গুলোতে শিশু শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে,বন্ধ করতে হবে শিশু-শ্রম,আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত না করা গেলে শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে ।

আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে নারী শিক্ষা পিছিয়ে থাকার কারণে এবং অর্থনৈতিক চাপে শিশুদের সব চাইতে নিরাপদ স্থান মা  শিশুদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না।নিজেদের অসহিষ্মু জীবনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাচ্চাদের উপর।শিশুরা হয়ে পড়ছে ভীত ,আস্থাহীন,তাদের মনেও অপরাধ প্রবণতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।

এই ধরণের পরিস্থিতি থেকে অবশ্যই শিশুদের বের করে আনতে হবে ,এর জন্য নিম্নোক্ত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী ।

১।মানসিকতার পরিবর্তন , শিশুরা যে আলাদা একটা স্বত্তা সেটা অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার ।

২।নারী শিক্ষা নিশ্চিতকরণ ,কেবল একাডেমিক শিক্ষা নয় ; মননে শিক্ষিত মা-ই পারেন সুন্দর ভাবে তার বাচ্চাকে বড় করতে ।

৩।শিশু উন্নয়নে পর্যাপ্ত বাজেট থাকা জরুরী এবং তা বাস্তবমুখী প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ ।

৪।যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং তার সঠিক প্রয়োগ ।

৫।শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ছেড়ে দেওয়া যেখানে খেলার মাঠ ও বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।

৬।একটি ভীতিহীন ,হাস্বোজ্জ্যল পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিশ্চিতকরণ ।

রোদেলা নীলা

লেখক ও গণমাধ্যম কর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here