প্রগতি ও উন্নয়ন ।। আবুল কাসেম ফজলুল হক

%e0%a6%86%e0%a6%ac%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%ae-%e0%a6%ab%e0%a6%9c%e0%a6%b2%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a6%95১. প্রস্তাবনা
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ঠিক  নেই বলে নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা আমরা যথেষ্ট ভোগ করতে পারি না। অপর দিকে নাগরিক দায়িত্ব পালনেও আমরা অল্পই আগ্রহী হই। আমাদের জীবন, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র সমাধানযোগ্য বহুবিধ সমস্যার চাপে পিষ্ট। এসবের সমাধান করা হলে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক সব দিক দিয়েই আমাদের প্রত্যেকের ও সকলের উন্নতির উপায় হবে। শূন্যবাদী (nihilist) ও নৈরাশ্যবাদীদের (pessimists) জীবনজগতদৃষ্টি একপেশে। সবদিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলে বোঝা যায়, হাজারো সমস্যা ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও জীবন ও জগত মানুষর জন্য অন্তহীন সম্ভাবনায় পূর্ণ। সভ্যতার ধারায় কখনো কখনো সঙ্কট অনেক বড় হয়ে দেখা দিলেও সার্বিক বিচারে মানবজাতির সম্ভাবনার দিকই বড়। ব্যক্তি ও জাতি বাস্তব অবস্থা ও সম্ভাবনা বিবেচনা করে নিজেই নিজের অবস্থা উন্নত করতে পারে।

যে অবস্থা চলছে তাতে সর্বাঙ্গীণ উন্নতির ধারায় উত্তীর্ণ হতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা ও কর্মধারা উন্নত করতে হবে। আমার ধারণা, বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে নতুন জিজ্ঞাসা ও আত্মসমালোচনা দেখা দেবে এবং মানবীয় শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে উন্নত নতুন উপলব্ধি জাগবে। তাতে দুনিয়াব্যাপী দেখা দেবে নতুন রেনেসাঁস। রেনেসাঁসের অগ্রগতির ধারায় দেখা দিবে গণজাগরণ।

নানা উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে চৌদ্দ শতক থেকে উনিশ শতক ব্যাপী ইউরোপে যে রেনেসাঁস গিয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি নয়- আমরা চাই নতুন কালের নতুন রেনেসাঁস। রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে সভ্যতা-সংস্কৃতি নবজন্ম লাভ করে। আগেরকার রেনেসাঁসের লক্ষ্য ছিলো মধ্যযুগের অনাচার থেকে মুক্ত হওয়া ও নতুন সৃষ্টি। অভীষ্ট নতুন রেনেসাঁসের লক্ষ্য হবে আধুনিক যুগের ভ্রান্তি, অন্যায় ও অনাচার থেকে মুক্ত হওয়া নতুন রেনেসাঁসের অভাবে সভ্যতার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এগুলো প্রধান সমস্যা রূপে সামনে এসেছে।

দুই বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে বিশ শতকের একেবারে শুরু থেকে নতুন রেনেসাঁসের জায়গায় কাউন্টার-রেনেসাঁস রূপে একে একে দেখা দিয়েছে ‘আধুনিকতাবাদ’ (modernism) ও ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’ (postmodernism)। তারপর ১৯৯০ -এর দশকে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ধারা ধরে সামনে আনা হয়েছে নব্যউদারতাবাদ (neoliberalism) ও  বিশ্বায়নকে। নব্যউদারতাবাদ ও বিশ্বায়নের কিছু নীতি ঘোষিত, কিছু অঘোষিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগিরা এই আদর্শ অনুযায়ী বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করে চলছে। এতে আছে বাজার অর্থনীতি, বহুত্ববাদ, অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ, সরকারের কর্তৃত্ব কমানো, এনজিও ও সিভিল সোসাইটি অরগেনাজেশনের বিস্তার ঘটানো, সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্বের সংস্কৃতি বিস্তার ঘটানো ইত্যাদি। জাতি ও রাষ্ট্রকে গুরুত্ব না দিয়ে এই মতবাদের অনুসারীরা চান ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে বিশ্বায়ন। নব্যউদারতাবাদ বাস্তবায়নে দুই প্রধান শক্তি হলো বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল। শিল্পোন্নত রাষ্ট্র সমূহের সংস্থা জি-সেভেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ন্যাটো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইত্যাদি ভীষণভাবে সক্রিয় আছে এই ধারায়। রেনেসাঁসের স্পিরিট হারিয়ে, কাউন্টার রেনেসাঁসের ধারায়, উত্তরাধুনিকতাবাদ, নব্যউদারতাবাদ ও বিশ্বায়ন অবলম্বণ করে ব্যক্তির, জাতির, রাষ্ট্রের ও গোটা মানবজাতির সমাধানযোগ্য সমস্যাবলির সমাধান ও স্বভাবিক বিকাশ সম্ভব নয়। যে অবস্থা চলছে, তাতে দুনিয়াব্যাপী বিপুল অধিকাংশ মানুষের অসন্তোষ আছে। সময়ের দাবি, প্রগতির লক্ষ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থ্যাকে পুনর্গঠিত করা।

আমার মনে হয়, তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিল্পব আর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের পর যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এক সময় পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ হাজার হাজার বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নততর নতুন জীবনপদ্ধতি, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠবে। পরিবর্তন নানা রূপ নিতে পারে। আমরা সার্বজনীন কল্যাণের লক্ষে পরিবর্তন চাই। এই বিবেচনাবশে, অভীষ্ট পরিবর্তনের উপায় সম্পর্কে এখানে আমি আমার কিছু ধারণা ব্যক্ত করব।

২. পরিবর্তন ও প্রগতি
পরিবর্তন ও প্রগতি এক নয়। পরিবর্তন আপনিতেই ঘটে এবং তা মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিরপেক্ষ। তবে মানুষ তার প্রয়োজনে ইচ্ছা করেও পরিবর্তন ঘটায়। মানুষ সজ্ঞানে, আপন ইচ্ছায়, দূরদর্শিতার সঙ্গে চিন্তা করে যেসব পরিবর্তন সাধন করে সেগুলোর কোনো কোনাটিতে প্রগতি থাকে। প্রগতি স্বতঃস্ফূর্ত গতি নয়, প্রগতি হলো মানুষের শুভ ইচ্ছা ও শুভ বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত গাতি। H. A. L Fisher এর একটি উক্তি : “The fact of progress is written plain and large on the pages of history; but progress is not a law of nature. The ground gained by one generation can be lost by the next.)”2

পৃথিবীতে সব কিছুই পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের সম্ভাবনা অন্তর্নিহিত (inherent) থাকে প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি ভাব ও প্রতিটি বিষয়ের মর্মে। বাইরের শক্তি প্রয়োগে কিংবা প্রভাবেও পরিবর্তন ঘটে। বাইরের শক্তি কিংবা প্রভাব কাজ করে ভেতরের কারণ বা সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে। জুলুম-জবরদস্তি ও যুদ্ধ আছে। পরিবর্তন হলো অবস্থান্তর, রূপান্তর,  ভাবান্তর, স্থানান্তর।

কেবল পৃথিবীতে নয়, যতটা অনুধাবন করা যায় তাতে মনে হয়, মহাবিশ্বের সব কিছুই নিরন্তর পরিবর্তিত হয়ে চলছে। কোনো পরিবর্তন দ্রুত, কোনোটি কম দ্রুত- চোখে পড়ে; কোনো পরিবর্তন মন্থর, কোনো কোনোটি অতি মন্থর- চোখেই পড়ে না। প্রাকৃতিক ও মানবীয় পরিবর্তনে অনেক রহস্য আছে। দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরা, ইতিহাসবিদেরা, এমনকি শিল্পী-সাহিত্যিকেরা পরিবর্তন নিয়ে চিন্তা করেন- আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও সৃষ্টি করেন। ইতিহাস তো ঘটনাপ্রবাহ অবলম্বন করে পরিবর্তনের রহস্যই সন্ধান করে। অতীত জানলে, বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করলে, ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা করা যায়, এবং ইচ্ছা করলে প্রগতি সাধন করা যায়। মহামানবেরা ইতিহাসের গতিনির্ধারক বা স্রষ্টা বলে অভিহিত হন। জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়েই তাঁরা কাজ করেন। বিবর্তনবাদ তো কারণ-কার্য সূত্র ধরে প্রাণীর ও মানুষের হয়ে-উঠার যথাসম্ভব তথ্যভিত্তিক বিবরণই দেয়। আসলে মানুষের ইতিহাসকে বুঝাবার জন্য আমাদের দরকার মানবীয় ঘটনাবলির কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র অনুধাবন করা। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতার জন্য পরিবর্তন সম্পর্কে কৌতহল, অনুসন্ধিৎসা ও তথ্য অপরিহার্য। পরিবর্তন ও ইতিহাস সম্পর্কে শিল্পকলা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদীদের আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিকতাবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুসন্ধিৎসা একপেশে এবং তাঁরা নৈরাশ্যবাদী কিংবা শূন্যবাদী।

আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আর পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকা নিয়ে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চিন্তা করেছেন মার্কস্, এঙ্গেলস্, প্লেখানভ, লেলিন ও মাও সে তুঙ। তাঁরা কেবল ভাবুক ছিলেন না, একই সঙ্গে ছিলেন ভাবুক ও কর্মী। মানবজাতির পরিবর্তনের গতি তাঁরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের উদ্ভাবিত বস্তুবাদী বিকাশতত্ত্বে (materialist dialectics) বিধৃত রয়েছে প্রকৃতিজগত ও মানবজগতের পরিবর্তনের রূপ-স্বরূপেই বিবরণ। অতীত ও বর্তমানের জ্ঞান নিয়ে তাঁরা ভবিষ্যতের কথা ভেবেছেন, এবং ভবিষ্যতকে তাঁদের বিবেচনা অনুযায়ী মানবজাতির জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বস্তুবাদী দ্বন্দ্ব দর্শনকে তাঁরা বিকাশশীল রূপে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু বাস্তব অনুশীলনে তাঁদের অনুসারীরা তাঁদের চিন্তাধারা ও সিদ্ধান্তকে এক রকম অপরিবর্তনীয় ধর্মে কিংবা মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছানিরপেক্ষ ব্যাপারে রূপান্তরিত করে ফেলেছিলেন। তাছাড়া, যে মানুষকে নিয়ে তাঁদের কাজ, সেই মানুষের স্বরূপ ও মনোজগতের দিকে তাঁরা দৃষ্টি দেননি। ধর্মের যা পরিণতি হয়েছে, মার্কসবাদেরও তাই হয়েছে। আর শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। মার্কসবাদে human nature ও proletarian character-কে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তা যথেষ্ট বাস্তবসম্মত নয়। শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের ধারণা মানবপ্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গিতিপূর্ণ নয় বলে তা এখন আবেদনহীন। মনোজগতের বিষয়গুলোর উপর যথোচিত গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে মার্কস্বাদের প্রবক্তা ও অনুসারীদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে পড়েছিল একপেশে। তবে তাঁরা পরিবর্তনের স্বরূপ ও গতি-প্রকৃতি সন্ধানে যে গুরুত্ব দিয়েছেন, তার উপযোগিতা ব্যক্তি, জাতি, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়নি, পুনর্গঠনের ও নবায়নের সুযোগ আছে। বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের এই কালে মানবজাতির জন্য পরিবর্তনের রহস্য সম্পর্কে নতুনভাবে কৌতহলী ও সন্ধিৎসু হওয়ার প্রয়োজন বেড়েছে বই কমেনি। মার্কস্বাদের বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু আছে। পরিবর্তিত বাস্তবতায় সর্বজনীন কল্যাণে মানববাদ, উপযোগবাদ, বস্তুবাদ, ভাববাদ, দ্বন্দ্বদর্শন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি ধারণার আমূল পুনর্বিবেচনা ও নতুন সংজ্ঞায়ন দরকার। পরিবর্তিত নতুন পৃথিবীতে পুরাতন ধ্যান-ধারণা নিয়ে চলা যাবে না। ইতিহাসের ধারায় সংশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মানবজাতির জন্য নতুন কালের নতুন আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা যেভাবে চলছে তা নিয়ে কেবল কায়েমি স্বার্থবাদীরাই সন্তুষ্ট- সবকিছু সম্পূর্ণরূপে তাদেরই দখলে।

বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, জি- সেভেন, ন্যাটো, জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বারা, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ধারা ধরে, বিশ্বায়নের যে মতবাদকে কার্যকর করা হচ্ছে, তা নিয়ে চললে মানুষের অনিবার্য পরিণতি হবে মানবিক গুণাবলি হারিয়ে পশুর পর্যায়ে নেমে যাওয়া। আদর্শগত দিক দিয়ে ইতিহাসের চাকাকে সম্পূর্ণ পেছন দিকে ঘোরানো হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মানুষকে পর্যায়ক্রমে অমানবিকীকৃত করে মানুষের উপর প্রভূত্ব করার ওয়াশিংটন- কেন্দ্রিক কার্যক্রমেরই নাম বিশ্বায়ন। ওকুপাই ওয়ালস্ট্রিট মুভমেন্ট (১৯১১-১২) থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি রাষ্ট্রের নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষেরা আর্তনাদ করে দুনিয়াকে জানিয়েছেন, বিশ্বায়ন হল নিরানব্বই শতাংশ মানুষকে বঞ্চিত করে এক শতাংশ মানুষের হীন স্বার্থ সাধন। বৈষম্য সংক্রান্ত তথ্য সন্ধান করলে রোমাঞ্চকর সব তথ্য সামনে আসে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় পড়ে ক্ষমতাবান ও ধনীরা হয়ে যাচ্ছে প্রবৃত্তির দাস আর বাকিরা অবস্থার দাস। বিশ^ব্যাংক ও আন্তর্জাতীক অর্থ তহবিলের অনুসারি অর্থনীতিবিদদের ও উন্নয়নবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা অত্যন্ত ক্ষতিকর। মানুষকে তাঁরা দেখেনে লোকের পি- হিসেবে। তাঁদের মতে সমাজে লোভ চরিতার্থ করার সুযোগ যত বেশি দেওয়া যাবে, উৎপাদন ও সম্পদ তত বাড়বে। ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনা, নৈতিক বিবেচনা, মানবতার বিবেচনা তাঁদের চিন্তায় স্থান পায় না।

বাইবেলে আছে, ‘Man does not live by bread alone.’ অন্য সব ধর্মগ্রন্থেও এধরনের উক্তি আছে। দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকেরাও এরকম কথাই বলে থাকেন। কেবল খাওয়া-পরা, ভোগ-বিলাস ও বিপুল সম্পত্তির মালিকানাই সব নয়। আজকের সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের মধ্যে, বিরাট-বিপুল সব সম্ভাবনার মধ্যে, অবাস্তব অবান্তর উদ্ভট অলীক সব ধারণা পরিহার করে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে এই উক্তির তাৎপর্য বুঝতে হবে। প্রবৃত্তিবশ্যতায় মানবতা থাকে না। মানুষকে নিরন্তর মানবায়িত (humanization of man is society) হয়ে চলতে হবে। নিজে বদলে যাওয়া এবং নিজের পরিবেশকে বদলে দেওয়া দুটোই অপরিহার্য। আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিবর্তনকে প্রগতিতে রূপ দেওয়ার সামর্থ্য মানুষের আছে। একা একলা যা করা যায় না, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা পারা যায়। এক জেনারেশনে যা পারা যায় না, জেনারেমেশর পর জেনারেশনের চেষ্টায় তা পারা যায়। সর্বজনীন কল্যাণে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনের উপায় সন্ধানে নতুন কৌতুহল, নতুন অনুসন্ধিৎসা ও নতুন কর্মপ্রচেষ্টা দরকার। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস ও শিল্প-সাহিত্যচর্চার ভুবনে ভালো সব কিছুর প্রতি চলমান অনাস্থার মনোভাব আর নৈরাশ্যবাদ ও শূন্যবাদের প্রতি আগ্রহের অবসান এবং বাস্তবসম্মত সদর্থক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বাঞ্ছনীয়।

৩. প্রগতির ধারণা ও প্রগতিশীল সামাজিক শক্তি
প্রগতি মানবীয় ব্যাপার- মানুষের ইচ্ছাসাপেক্ষ, অর্জনসাপেক্ষ, প্রয়াসসাধ্য। সব কিছুই গতিশীল, কিন্তু সব কিছু প্রগতিশীল নয়। কোনো জনগোষ্ঠীর কিংবা জাতির মধ্যে যে চিন্তা ও কাজের দ্বারা অনুশোচনাহীন অপরাধীদের ছাড়া বাকি সবার কম-বেশি কল্যাণ হয়, সভ্যতার ধারায় নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ে উত্তরণ সম্ভব হয়, তার মধ্যেই প্রগতি নিহিত থাকে। প্রগতিতে পর্যায়ক্রমে সকল লোকের সম্ভবপর সবচেয়ে বেশি কল্যাণ বাঞ্ছনীয়। অগ্রগতি না থাকলে, বিকাশ না থাকলে, উৎপাদন সৃষ্টি ও বৃদ্ধি না থাকলে, প্রগতি হয় না। আবার যেকোনো অগ্রগতি, যেকোনো বিকাশ, যেকোনো বৃদ্ধি, প্রগতি নয়; প্রগতির মর্মে থাকে যুগপৎ সৃষ্টিশীলতা ও মূল্যবোধ, কার্যকর নৈতিক চেতনা ও আদর্শবোধ এবং সর্বজনীন-কল্যাণ অভিমুখী, বাস্তবসম্মত, বাস্তবায়নসম্ভব কর্মসূচি ও কার্যক্রম।

প্রগতির ধারণা ইতিহাসের দর্শনের (philosophy of history) অন্তর্গত। প্রগতির স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা কমই পাওয়া যায়। তবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে চিন্তার ক্ষেত্রে, প্রগতির ইতিহাস অনেকে রচনা করেছেন। বিভিন্ন সভ্যতার ও প্রগতির ইতিহাস রচিত হয়েছে।৩ বিভিন্ন সামাজিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ও চিন্তার সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় সমাজ। সামাজিক শক্তির কোনটি প্রগতিশীল, কোনোটি রক্ষণশীল, কোনোটি প্রতিক্রিয়াশীল। প্রগিতশীল ব্যক্তিকে প্রগতিশীল সামাজিক মুক্তির অন্তর্গত থেকে নিজের ভূমিকা পালন করতে হয়। যাকে বলা হয় সভ্যতা, নানা কিছুর সঙ্গে তার মর্মে থাকে প্রগতি। কোনো সভ্যতার মর্মে যদি প্রগতি লোপ পায়, তা হলে অচিরেই সেই সভ্যতাও লোপ পেয়ে যায়। প্রতিটি সভ্যতার মধ্যে প্রগতির বিপরীতে থাকে প্রতিক্রিয়া। রক্ষণশীলেরাও প্রগতিই অবলম্বন করেন। তবে তাঁদের বিচার-বিবেচনা বেশি ও গতি মর্ন্থর J.B. Bury ইউরোপের উন্নত জাতিসমূহের আধুনিক যুগের ইতিহাসে লক্ষ্য করেছেন : “Progress is he characteristic idea of the age, ardently received by some, hotly denounced by others. …the idea of progress, whether accepted or not, is familiar to all minds and is conceived as the future of humanity.”4

প্রত্যেক জাতির ইতিহাসেই দেখা যায়, প্রগতিশীল ধারা সব সময় প্রগতিশীল থাকে না, কখনো কখনো রক্ষণশীল হয়ে পড়ে- নানাভাবে বিকারপ্রাপ্তও হয়। আর রক্ষণশীল ধারাও সব সময় রক্ষণশীল থাকে না, কখনো কখনো প্রগতিশীল হয়ে ওঠে। কোনো জনগোষ্ঠীতে কিংবা জাতির মধ্যে সব মানুষ প্রগতিশীল নয়, অনেকে প্রগতিশীল, অনেকে রক্ষণশীল, কিছু লোক প্রতিক্রিয়াশীল, আর বিপুল অধিকাংশ উদাসীন যারা অন্যের বা অন্যদের দ্বারা পরিচালিত। বাস্তবে দেখা যায়, পরিবর্তনশীল পরিবেশে সারা জীবন কেউই এক চিন্তা নিয়ে কিংবা কোনো অপরিবর্তনীয় নীতি নিয়ে চলতে পারেন না।

ইউরোপে রেনেসাঁসের বিকাশের এক পর্যায়ে বিকশিত হয়েছিল progress-এর ধারণা যার বাংলা করা হয়েছে ‘প্রগতি’। লক্ষ করলে দেখা যায়, বাংলা ‘উন্নতি’ শব্দটি ইংরেজি progress-এর সমার্থক। উন্নতি, প্রগতি, progress এই তিনটি শব্দেরই অর্থের মধ্যে বৃদ্ধির সঙ্গে সদিচ্ছা, সর্বজনীন কল্যাণ ও উন্নত নেতৃত্বের ধারণা যুক্ত। এতে যুক্ত থাকে জনগণের উন্নত আর্থিক জীবনের সঙ্গে উন্নত মানসিক জীবন প্রতিষ্ঠারও লক্ষ্য। জাতীয় জীবনে উন্নতি বা প্রগতির জন্য আর্থিক সমৃদ্ধির সঙ্গে নৈতিক উন্নতি অপরিহার্য। প্রগতির জন্য ন্যায়-অন্যায়ের বাস্তবসম্মত বিবেচনা ও ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন অপরিহার্য।

প্রত্যেক ঐতিহাসিক পর্যায়ে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর প্রগতি বা উন্নতির জন্য নেতৃত্বের দিক থেকে জনজীবনের লক্ষ্য ও কর্মসূচি নির্ণয় এবং সেই লক্ষ্য ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা দরকার হয়। চিন্তাশীলতা, শ্রমশীলতা, সাধনা, সংগ্রাম, বিবর্তন, বিপ্লবÑ এগুলো প্রগতির বা উন্নতির অবলম্বন। উন্নতির বা প্রগতির মর্মে থাকে একই সঙ্গে উৎপাদনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা ও ন্যায়পরতা। কেবল ব্যক্তিগত চেষ্টায় হয় না, সম্মিলিত চেষ্টা লাগে। কেবল মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি, কিংবা মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধি, কিংবা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শতকরা হার দিয়ে প্রগতির পরিমাপ হয় না। প্রগতি পরিমাপের জন্য উন্নয়নের পরিমাপকগুলোর সঙ্গে নৈতিক উন্নতির পরিমাপকও যুক্ত করা অপরিহার্য। অপরাধ ও অন্যায় কমাতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে মানুষের পক্ষে পালন করা সম্ভব বা উচিত এমন আইন প্রবর্তন করতে হবে। জাতীয় জীবনে নৈতিক উন্নতি-অবনতির পরিমাপক উদ্ভাবন করতে হবে।

প্রগতির পথ কুসুমাস্তীর্ণ থাকে না; জাতীয় জীবনে প্রগতিপ্রয়াসী সঙ্ঘশক্তির অভাবে কখনো কখনো প্রগতির পথ বিলুপ্তও হয়ে যায়। তখন কাউকে কাউকে কঠিন ব্রত নিয়ে একা একাই পথ তৈরি করে করে সামনে চলতে হয়। তারপর প্রগতি-অভিলাষী জনসম্পৃক্ত সঙ্ঘশক্তি গড়ে তোলা গেলে পথ ও বিপথের পার্থক্য স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশে যে সময়টা এখন আমরা অতিক্রম করছি, তাতে প্রগতিশীল কোনো সামাজিক শক্তির সন্ধান পাওয়া যায় না। আজকাল এখানে অনেকে কেবল ধর্মনিরপেক্ষতাকে কিংবা ধর্মের বিরোধিতা করাকে প্রগতি বলে প্রচার করেন। আজকের দিনে প্রগতি সম্পর্কে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ও বিভ্রান্তিকর। বাংলাদেশে এবং আরো অনেক রাষ্ট্রে ধর্মীয় শক্তির ও পুরাতন সংস্কার-বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন ও প্রসার ঘটল কেন, তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখা দরকার। গণতন্ত্রের নামে, সমাজতন্ত্রের নামে, বিশ্বায়ন ও উদারনীতির নামে যেসব অপকর্ম চালানো হচ্ছে, সেগুলোর অবসান ঘটিয়ে প্রগতির পথ উন্মুক্ত করতে হবে। বিশ^ব্যাংক যে ধারণা দিচ্ছে এবং জাল বিস্তার করে আছে তা থেকে মুক্ত হতে হবে।

প্রত্যেক জাতি ও গোটা মানবজাতি স্বাভাবিক অবস্থায় চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে প্রগতির ধারায় চলে। শ্রীঅরবিন্দের লেখায় আছে : “মানুষের মধ্যেÑ যে একটা প্রগতি বা ক্রমপরিণতি চলিতেছে, কেহ কেহ তাহা ভ্রান্তিমাত্র মনে করেন; কারণ তাঁহাদের কল্পনা এই যে, মানবজাতি সর্বদা একস্থানে থাকিয়া চক্রাকারে ঘুরিতেছে। অথবা তাঁহাদের দৃষ্টিতে বর্তমান অপেক্ষা অতীতেই অধিক পরিমাণে মহত্ত্ব বিদ্যমান ছিল এবং অগ্রগতির পথ ঊর্ধ্বমুখে না গিয়া অধঃপতনের দিকে গিয়াছে। কিন্তু এ মত ভ্রান্ত। ভ্রান্তির কারণ, আমরা অতীতের উচ্চ আলোকিত স্থানের উপর অত্যন্ত বেশি দৃষ্টি রাখিয়া তাহার অন্ধকার ও ছায়াছন্ন প্রদেশসকল দেখিতে পাই না, পক্ষান্তরে বর্তমানের তমসাবৃত স্থানগুলির দিকে দৃষ্টি দিয়া তাহার আলোকময় শক্তি, উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনাসকল দেখি না। প্রগতির পথ অবন্ধুর নয়, চলিবার পথে পতন ও উত্থান আছে, আর তাহা হইতেই এ ভুল সিদ্ধান্ত জাত হইয়াছে।… মানুষের প্রগতি অজানা দেশের মধ্য দিয়া এক দুঃসাহসিক অভিযান।… প্রশ্ন এই- আমরা কোন দিকে চলিয়াছি, প্রকৃত পথ কোনটি এবং আমাদের এই সমুদ্রাভিযানে আমরা কোন বন্দরে পৌঁছিব?” সংস্কৃতির স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে অরবিন্দ লিখেছেন : “পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য স্থাপনই সংস্কৃতির জীবন্ত লক্ষ্য।”৫ তাঁর মতে, সংস্কৃতির অস্তিত্ব মানুষের সকল কর্মকান্ডের মর্মে।

৪. উন্নয়ন উন্নতি প্রগতি
‘উন্নতি’ ও ‘উন্নয়ন’ এক নয়। ‘উন্নতি’ মানে উপরে ওঠা, আর ‘উন্নয়ন’ হল উপরে তোলা। উন্নতি নিজের শক্তিতে, নিজের বৃদ্ধিতে নিজেকে করতে হয়; তাতে অন্যের সহায়তা, যতটা সম্ভব, নিজের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব বজায় রেখে নিজেকে নিতে হয়। আর উন্নয়ন অন্যের ইচ্ছায় অন্যের পরিচালনায় অন্যের কর্তৃত্বে সাধিত হয়; তাতে নিজের স্বাধীনতা থাকে না। আজকের পৃথিবীতে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, ধনী রাষ্ট্রগুলোর অর্থলগ্নিকারী বিভিন্ন সংস্থা, বৃহৎ শক্তিবর্গের বাণিজ্যনীতি কূটনীতি ও গোয়েন্দানীতি ইত্যাদির সঙ্গে গরিব রাষ্ট্রগুলোর উন্নয়ন সম্পূর্ণ শর্তাবদ্ধ। উন্নয়নের ধারণা ও কার্যক্রম উন্নতি বা প্রগতির ধারণা ও কার্যক্রম থেকে ভিন্ন। বহিরারোপিত উন্নয়নের ধারণা এবং কথিত উন্নয়ন-সহযোগীদের ও কথিত দাতাসংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে চলতে গিয়ে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে চলছে। দুর্বল থাকলে শোষিত ও বঞ্চিত হতে হয়Ñ দরিদ্র থাকতে হয়। দুর্বলরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হতে পারে এবং অধিকার ও মর্যাদা অর্জন করতে পারে। তাদের স্থায়ীভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকা কর্তব্য। এর জন্য তাদের নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হয়।

উচ্চ-ফলনশীল বীজ, দ্রুত-বংশবৃদ্ধিকারী হাঁস-মুরগি-মাছের চাষ, পোশাকশিল্প, বিদেশে আয় করার জন্য শ্রমিক প্রেরণ এবং আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীতে সৈন্য প্রেরণের দ্বারা বাংলাদেশ ১৯৮০-র দশক থেকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে। বাংলাদেশে সরকার বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য এখন অনেক কম নেয়; এখন বৈদেশিক সাহায্য নেয় এনজিওগুলো এবং সিভিল সোসাইটি অরগেনাইজেশনগুলো, যার প্রকৃত হিসেব সরকার কিংবা দেশবাসী কাউকেই স্বচ্ছভাবে জানানো হয় না। এনজিও ও সিভিল সোসাইটি অরগেনাইজেশন হল বাংলাদেশের ভেতরে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের দ্বারা পরিচালিত সংস্থা। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলো এখন ‘দাতা সংস্থা’ ও ‘উন্নয়ন-সহযোগী’ নাম নিয়ে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ আজ এমন এক অবস্থায় পড়েছে যে, তার গুরুত্বপূর্ণ সব কিছু নির্ধারিত হচ্ছে বিদেশী অর্থলগ্নিকারীদের ও কূটনীতিকদের পরিকল্পনা ও আদেশ-নির্দেশ দ্বারা। বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে, জাতীয় সংসদে, সিভিল সার্ভিসে, হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে, বিশ^বিদ্যালয় গুলোতে বেশ কিছু লোক আছেন যাঁরা জন্মগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও পছন্দগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। অনেকের ছেলে-মেয়ে ওই সব রাষ্ট্রের নাগরিক। এই লোকদের জাতীয়তাবোধ ও রাষ্ট্রবোধ বাংলাদেশের সম্পূর্ণ অনুকূল নয়। বাংলাদেশের পরিচালনায় ও নীতি নির্ধারণে এঁদের কর্তৃত্ব ক্রমগত বাড়ছে। যে মূলনীতি অনুসারে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো চলে, তা হল বৃহৎ শক্তিবর্গের ‘আধিপত্য ও নির্ভলশীলতা নীতি’ (dominance and dependence)। এই নীতির কবলে পড়ে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো আরো দুর্বল হচেছ এবং স্বাধীনতা হারাচ্ছে। স্বাধীনতা হারানো আর নিঃস্ব হওয়া একই কথা। স্বাধীনতা হারালে নিজের দেহ-মনের উপরও নিজের কর্তৃত্ব থাকে না।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রেগান ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেচারের শাসনকালে বৃহৎ শক্তিবর্গ মানবজাতিকে পরিচালনার জন্য যে আদর্শ অবলম্বন করেছে তা হল নব্যউদারতাবাদ (neo-liberalism)। এই আদর্শ স্বাধীনতার নামে মানুষের সামাজিক সত্তাকে গুরুত্ব দেয় না, অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে পরিহার করে এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, বহুত্ববাদ, অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ ও বাজার অর্থনীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে বহুত্ববাদের নামে তারা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কিংবা বহুত্বমূলক সমন্বয়ের নীতি বাতিল করে এবং এনজিও ও সিভিল সোসাইটি অরগেনাইজেশন গড়ে তোলে।

উন্নতির ধারণা আমাদের নিজেদের, আর উন্নয়নের তত্ত্ব পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ কর্তৃক আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। আমাদের উন্নতির ধারণাকে অপসৃত করে তার জায়গায় গ্রহণ করা হয়েছে উন্নয়নের ধারণা- যা পশ্চিমা আধিপত্যবাদীদের কর্তৃত্ব ও শোষণকে নিশ্চিত করেছে। উনিশ শতক এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলা ভাষার চিন্তক ও কর্মীদের রচনাবলিতে ‘উন্নতি’ কথাটিই পাওয়া যায়, ‘উন্নয়ন’ পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকভাবে ওই সময়কার লেখক-চিন্তকদের ভূমিকা ছিল সৃষ্টির ও প্রগতির অনুকুল। বাংলাদেশের এখনকার সামনের সারির লেখক-চিন্তক-গবেষকদের ভূমিকা কি আদৌ প্রগতিশীল? আগে উল্লেখ করেছি, আজকের দিনে কেবল ধর্মনিরপেক্ষতায় কিংবা ধর্মের বিরোধিতায় প্রগতি নেই। এখন প্রগতি সাধন করতে হলে আধুনিক যুগের মূল প্রত্যয় সমূহের সমালোচনা ও সংশোধন অবলম্বন করে উন্নতির নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সর্বাঙ্গীন আদর্শিক লক্ষ্য ও সেই লক্ষ্য অভিমুখী কর্মসূচি অবলম্বন না করে, গণতন্ত্রকে ব্যর্থ করে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচার করলে এবং মৌলবাদ মোকাবিলায় ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে মত্ত থাকলে তার দ্বারা ধর্মীয় শক্তির, পুরাতন সংস্কার-বিশ্বাসের ও জঙ্গিবাদের উত্থান বন্ধ হয় না। প্রগতির দ্বার উন্মুক্ত করতে হলে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ন্যাটো যে আগ্রাসন চালাচ্ছে ও যুদ্ধ চালাচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে- সকল বিদেশি সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৫০ এর দশকের প্রথম দিক থেকে বাংলা ভাষায় ‘উন্নতি’ শব্দটির ব্যবহার কমিয়ে ক্রমে তার স্থলাভিত্তিক করা হয়েছে ‘উন্নয়ন’কে (development)। বাংলাদেশকালে এসে উন্নতি শব্দটি আমরা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছি এবং উন্নয়ন ছাড়া আমাদের একদিনও চলে না। আমরা আমাদের স্বকীয় ধারণাকে বিকাশশীল ও কার্যকর রাখার এবং কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের প্রয়োজনে নতুন ধারণা উদ্ভাবনের কথা ভাবিনি। উন্নতির কোনো সূচকও আমরা নির্ণয় করিনি। আমার আত্মশক্তিতে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি আমাদের নিয়ে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রয়োজনে, তাদর দ্বারা উদ্ভাবিত ও তাদের দ্বারা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সাম্রাজ্যবাদী সব ধারণা, কর্মনীতি ও কার্যক্রম। আমরা ব্যবহৃত হচ্ছি সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্য সাধনের যন্ত্র রূপে। ক্রমে আমাদের চিন্তা বদলে গেছে, কাজের ধারাও বদলে গেছে। আমাদের মগজ সম্পূর্ণরূপে ধোলাই করা হয়েছে এবং চিন্তনপদ্ধতিকে বদলে দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা নিজেদের হীন (inferior) ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সামর্থ্য হারিয়ে আমরা পরিণত হয়েছি চিন্তাপ্রতিবন্ধী জাতিতে। উন্নয়নের প্রশ্নে সর্বজনীন কল্যাণের কথা না ভেবে আমরা চিন্তা করছি কেবল-শাসক শ্রেণির পাঁচ শতাংশের স্বার্থে। অর্থনীতিবিদেরা ও উন্নয়নবিদেরা তো এই পথই আমাদের প্রদর্শন করে আসছেন।

এমনটা যে কেবল বাংলাদেশে ঘটেছে তা নয়, সব দুর্বল রাষ্ট্রই আজ এই বাস্তবতার মুখোমুখী। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো ‘উন্নয়নশীল’ নাম পেয়েছে বটে, কিন্তু চলমান প্রক্রিয়ায় আত্মরক্ষার এবং শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হওয়ার কিংবা উন্নতি করার উপায় হারিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের (১৯৯১) পর মুক্তিকামী জনগণের দিক থেকে কোনো আন্তর্জাতিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়নি। বিশ্বায়নের অভিঘাতে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো তাদের রাষ্ট্রসত্তা হারিয়ে চলছে। বাংলাদেশ তার রাজনীতি হারিয়েছে। অনেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকার কথা বলছেন। সেটাও আছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের তৎপরাতার বিপরীতে ভারতের তৎপরতা দেখা গেছে। এসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের তৎপরতা সফল হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা ব্যর্থ হয়েছে। ভারতের ভূমিকা ছাড়া এই নির্বাচন এভাবে হতে পারত না।

সাধারণত উন্নয়নকে বর্ণনা করা হয় মহিমান্বিত করে। আলোচনায় উন্নতির কিছু উপাদানকেও স্থান দেওয়া হয়। কিন্তু তা কাগুজে ব্যাপার মাত্র। বাস্তবের সঙ্গে কেতাবি ধারণার মিল নেই। শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের মাপকাঠি মাথাপিছু গড় আয় বা মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার, কিংবা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার। নানাভাবে পঁচানব্বই শতাংশ মানুষের বঞ্চনার চিত্রকে আড়াল করা হয়। উন্নয়নকে সীমাবদ্ধ রাখা হয় কেবল ডলার কিংবা টাকা দিয়ে যার মূল্য নির্ণয় করা যায় তারই মধ্যে। বিশ্ববিস্তৃত বাজার অর্থনীতির, বুহুত্ববাদের ও অবাধ প্রতিযোগিতাবাদের সব অন্যায় এর সঙ্গে যুক্ত।

প্রগতির ধারণাও উন্নয়নের ধারণা থেকে ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের অভিলাষে দুর্বল দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য উন্নয়নের ধারণা উদ্ভাবন করে। তখন থেকে উন্নতির ও প্রগতির ধারণাকে আর বিকশিত করা হয়নি।

সভ্যতার উত্থান-পতন ও আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার অবক্ষয় সম্পর্কে আলবার্ট সুইটজারের মত,৬ জাতীয় সংস্কৃতির উত্থান-পতন ও আধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতির অবক্ষয় সম্পর্কে ওস্ওয়াল্ড স্পেংলারের মত,৭ পৃথিবীর কোথাও রাজনীতিবিদদের কাছে গুরুত্ব পায়িনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রগতির ধারণা ধরে রেখেছিল বটে, কিন্তু দেশ-কালের উপযোগী করে সে ধারণাকে বিকশিত করেনি। বাংলা ভাষায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতির ধারণ কিছুটা বিস্তার লাভ করেছিল; কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে কিংবা বাংলাদেশে কোথাও কোনো সূচক বা পরিমাপক নির্ণয় করা হয়নি। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘উন্নয়ন’-এর ধারণা কার্যক্ষেত্রে ১৯৫০-এর দশকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বহুলাংশের গ্রহণ করে নিয়েছিল এবং মার্কসীয় ডায়লেকটিক্স বা ইতিহাসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী ধারণা সৃষ্টিশীল উপায়ে অনুধাবন করেনি। ‘প্রগতি’ বা ‘উন্নতি’র মর্মও সে ভুলে গিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে (১৯৯১)। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দার্শনিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা The End of History নামে বই লিখে পুঁজিবাদের চিরবিজয় ঘোষণা করেছেন।৮ তিনি মত প্রকাশ করেছেন যে, মার্কসীয় ইতিহাসের ধারণার চিরঅবসান ঘটে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্য দুই রকম কারণই ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে শেষ করে দিতে। সোভিয়েট ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার জন্য অভ্যন্তরীণ কারণই মূল, বাহ্য কারণ অভ্যন্তরীণ কারণের মধ্য দিয়ে কাজ করেছে। ফুকুয়ামা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিশ্বায়নের ও নব্যউদারতাবাদের লক্ষ্য সামনে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপে ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছেন।

ফুকুয়ামার গ্রন্থটির সম্পূরক হিসেবে বিশ্বায়নের ও নব্যউদারতাবাদের লক্ষ্য সামনে নিয়ে স্যামুয়েল পি হ্যান্টিংটন সভ্যতার সাংস্কৃতিক দিক অবলম্বন করে রচনা করেছেন The Clsh of Civilizations9 বিশ্বায়নের ও নব্যউদারতাবাদের লক্ষ্য সামনে নিয়ে ড. ইউনুস প্রচার করছেন তাঁর সামাজিক ব্যবসার তত্ত্ব।১০

৫. বাংলাদেশে প্রগতিবিমুখ চিন্তার তিন ধারা;
বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আমরা আত্মশক্তির স্বাভাবিক বিকাশ চাই- উন্নতি চাই, প্রগতি চাই, progress চাই। উন্নয়ন থাকবে এবং তার পরিকল্পনায় অবশ্যই থাকা চাই রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বাধীনতা। উন্নয়নের ধারণাকে অবলম্বন করতে হবে সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিহার করে, জাতীয় ঐতিহ্যের ধারা ধরে। উন্নয়নকে হতে হবে রাষ্ট্রের, জাতির ও জনজীবনের সার্বিক উন্নতির বা প্রগতির অবলম্বন। আমরা আমাদের জন্য ও অন্য সব জাতির জন্য সমৃদ্ধ-সুন্দর-প্রগতিশীল নতুন ভবিষ্যত চাই। পাশ্চাত্য শক্তিশালী  জাতিগুলো থেকে আমরা আমাদের সত্তায় তাদের প্রগতিশীল মহান দর্শন-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গ্রহণ করতে চাই। এ উদ্দেশ্যে জাতীয় জীবনের নানা কাজের মধ্যে আমরা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের চর্চা চাই। শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় ইতিহাসের যথোচিত স্থান চাই। ইতিহাসচর্চায় ও ভবিষ্যতচিন্তায় আমরা আত্মশক্তির উপর নির্ভর করে প্রগতি বা উন্নতির ধারণাকে অবলম্বন করে এগোতে চাই। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা চাই। বিচার বিভাগ ও উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রচলন চাই। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের ‘আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি’ অবশ্যই পর্যায়ক্রমে আমাদের পরিহার করতে হবে। এর জন্য দরকার সুদৃঢ় জাতীয় নেতৃত্ব, জাতীয়তাবোধ, জাতীয় ঐক্য ও সর্বজনীন গণতন্ত্রের লক্ষ্য। আজকের বাস্তবতায় সর্বজনীন গণতন্ত্রের ধারণাকে বাংলাদেশের জন্য আমাদের সৃষ্টি করে দিতে হবে।

নতুন ভবিষ্যত সৃষ্টি করতে হলে অতীত সম্পর্কে ধারণাকেও পুণর্গঠিত ও নবায়িত করতে হয়। অতীত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা অপরিবর্তিত রেখে উন্নত ভবিষ্যত সৃষ্টির চেষ্টা সফল হয় না। এজন্য প্রত্যেক জেনারেশনকেই তার ইতিহাস নতুন করে রচনা করতে হয়।

বাংলাদেশের লেখক-শিল্পীদের একটি ধারায় দেখা যাচ্ছে শান্তিনিকেতনের ও কলকাতার সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ। তাঁরা প্রগতিসচেতন নন। তাঁরা গতানুগতিপ্রিয়। ধর্মনিরপেক্ষতা তাঁদের প্রিয়, কিন্তু সর্বজনীন গণতন্ত্রের প্রশ্নে তাঁরা অনীহ। প্রগতি সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ভুল। ইসিহাসের চাকা ফে পেছন দিকে ঘুরছে, সে সম্পর্কে তাঁদের কোনা অনুসন্ধিৎসা নেই। অপর একটি ধারায় দেখা যাচ্ছে শান্তিনিকেতনের, কলকাতার ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ মনোভাব। তাঁরা মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ইতিহাসের ভাসাভাসা ধারণার মধ্যে নিজেদের সংস্কৃতির উৎস সন্ধান করেন। তাঁরা প্রগতিবিমুখ- বিভ্রান্ত। কোনোটির মধ্যেই আত্মশক্তিতে আস্থা ও জাতীয়তাবোধ নেই। কথিত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ কিংবা কথিত ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ -কোনোটিতেই ‘জাতীয়তাবাদ’ নেই, আছে পশ্চিমা কেবল সাম্রাজ্যবাদী নীতির অন্ধ অনুসরণ।

চিন্তার ক্ষেত্রে যাঁরা সবচেয়ে শক্তিশালী তাঁরা ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীদের অন্ধ অনুসারী, তাঁরা সিভিল সোসাইটি অরগেনাইজেশনগুলোর বিশিষ্ট নাগরিক ও এনজিওপতি। চিন্তার ক্ষেত্রে এই তৃতীয় ধারার কোনো স্বকীয় সত্তা নেই, বিদ্বান ও ক্ষমতাবান হলেও চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁরা একেবারেই পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের লেজুড়। পুতুল নাচের সুতা টানে ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীরা। বাংলাদেশে উন্নয়নকে তাঁরা বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের পরিকল্পনার সম্পূর্ণ অধীন মনে করেন। প্রচলিত আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ঘটনাপ্রবাহে এই তিন ধারারই রয়েছে সক্রিয় ভূমিকা।

চিন্তার ও কর্মের এই তিন ধারার প্রত্যেকটিই আত্মশক্তিতে আস্থাহীন প্রগতিবিমুখ- আন্তরিকতাবিমুখ। এগুলোর বাইরে আছে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি প্রবণতা। এ অবস্থায় উন্নত নতুন ভব্যিষত সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতীয় জীবনে গতানুগতির বদলে দরকার নতুন প্রাণশক্তির উদ্বোধন। বাংলাদেশে এখন প্রগতিশীল কোনো রাজনৈতিক শক্তি যেমন নেই, তেমনি প্রগতিশীল কোনো বৌদ্ধিক শক্তিও (intellectual force) নেই। প্রগতিশীল ব্যক্তিক প্রয়াস কিছু আছে, তবে সেগুলোর প্রতি বৃহত্তর শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি নেই। জ্ঞানী হলেই কোনো ব্যক্তি প্রগতিশীল হয় না। বাংলাদেশে প্রগতির স্পিরিট ভিন্ন। প্রগতিশীল শক্তির উত্থান কীভাবে সম্ভব হবে, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।

৬. মানবোন্নয়ন ও মানবপুঁজি;
‘মানবসম্পদ-উন্নয়ন’ (human resource development) পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের পুঁজি  গণ্য করা হয়। এক শ্রেণির লোকেরা নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অন্য এক শ্রেণীর লোককে  মুনাফার পরিণত করে। উন্নয়নের পক্রিয়ায় পুঁজিতে শ্রমিকদের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। শ্রমিকদের মুনাফার পুঁজি গণ্য করে তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মনৈপুণ্য ইত্যাদির উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়; পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে শ্রমিকদের সত্তাকে স্বীকার করার কিংবা তাদর সর্বমাত্রিক বিকাশের কথা ভাবাই হয় না। একই মনোবৃত্তির প্রকাশ আছে মানবপুঁজি (human capital) কথাটির মধ্যেও। ‘মানবসম্পদ’ (manpower) রফতানি করছে গরিব তথা দুর্বল রাষ্ট্র, আর আমদানি করছে ধনী তথা শক্তিশালী রাষ্ট্র। শক্তিশালী রাষ্ট্রের লোকেরা তাদের রাষ্ট্রের কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলো করাচ্ছে দুর্বল রাষ্ট্র সমূহ থেকে মানবসম্পদ আমদানি করে তাদের দিয়ে। মানবোন্নয়ন (human development) বলে মানুষকে গড়ে তোলার যে আয়োজন, কার্যক্ষেত্রে তারও উদ্দেশ্য এক শ্রেণির মানুষের স্বার্থ হাসিলের পুঁজি রূপে আর এক শ্রেণির মানুষকে ব্যবহার করা। যারা ব্যবহারকারী তাদের সংখ্যা অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু তারা শক্তিশালী; আর যারা ব্যবহৃত হয় তাদের সংখ্যা অনেক বড়, কিন্তু তারা দুর্বল। যাঁরা শক্তিশালী ও কর্তৃত্বশীল তাঁরা তাদের প্রয়োজনে এসব তত্ত্বের ও কর্মধারার বিকাশ ঘটিয়েছেন। ইতিহাসের ধারায় মানুষ বদলাচ্ছে। অতি মন্থর গতিতে মানুষের সমাজে মানবিক গুণাবলি বিকশিত হচ্ছে। এই বিকাশের ধারা সরল রৈখিক নয়, এতে উত্থান-পতন আছে। মানবসমাজে আজো দুর্বলের আপন সত্তায় টিকে থাকার উপায় নেই। বিজ্ঞানের এই উন্নতির যুগেও বসুন্ধরা আগের মতোই বীরভোগ্য। বীর মানে শক্তিশালী, প্রবল, জবরদস্তিকারী। মানুষ দুর্বল হলেই নির্জিত হয়, শোষিত হয়, বঞ্চিত হয়। নির্জিত শোষিত বঞ্চিত মানুষ কেবল ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হতে পারে এবং নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। দুর্বল থাকা অন্যায়। ঐক্যবদ্ধ হতে হলে নেতৃত্ব বা দল গড়ে তোলা অপরিহার্য। দলের জন্য নেতা দরকার হয়। নিজেদের কল্যাণে, নিজেদের ভেতর থেকে, নিজেদের চেষ্টায় নেতা ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হয়। গোটা প্রক্রিয়ায় নীতি ও আদর্শ দরকার হয়। মার্কসীয় সমাজতন্ত্রে শ্রমিকদের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয়ের পর সে চেষ্টা আর নেই।

উন্নয়নের সূচকগুলোর মধ্যে মোট জাতীয় আয় বা মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধির হারই মূল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (economic growth) কথাটা দ্বারাও শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারটাই বোঝানো হয়। উন্নয়ন যেভাবে হিসেবে করা হয় তাতে প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়কেই বিবেচনার বাইরে রাখা হয়। উৎপাদনের সঙ্গে বণ্টনের প্রশ্ন, ঔচিত্য-অনৌচিত্যের প্রশ্ন, সামাজিক ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন বিবেচনাই করা হয় না। বিচারব্যবস্থা, আইন, আইনের শাসন কার্যকর বিবেচনা পায় না। সেই ১৯৫০-এর দশক থেকে মাঝে মাঝেই উন্নয়নের ধারণা, সংজ্ঞা, সূচক ও প্রকৃতি নিয়ে ক্রমাগত তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তবে তাতে তাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে প্রায়েগিক নীতির পার্থক্য কমেনি। কালক্রমে উন্নয়নের আদি সূচক সমূহের সঙ্গে নতুন সূচক যুক্ত হয়েছে। জনগণের জীবনযাত্রার মানকে বিচার্য বিষয়ের মধ্যে গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য স্বতন্ত্র নানা আয়োজন করা হয়েছে। দুর্বলদের শক্তিশালী করার ও ধনীদের সহ সকলের সামাজিক গুণাবলি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে কিছু করা হয়নি।

সামাজিক ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে উন্নয়নবিদরা সম্পূর্ণ উদাসীন হলেও দুর্নীতি নিয়ে আজকাল তাঁদের হৈ-চৈয়ের অন্ত নেই। দুর্নীতি-বিরোধী সকল আয়োজনই প্রচলিত ব্যবস্থাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে করা হয়। এ বিষয়ে প্রায় সব আলোচনায় জনগণের আশা-আশাক্সক্ষার জগতকে আর বাস্তবতার ঐতিহাসিক পটভূমিকে বিবেচনার বাইরে রাখা হয়। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নকে সজ্ঞান-প্রয়াসে পরিহার করে চিন্তনপদ্ধতি ও সিদ্ধান্তকে value-free রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় পরনির্ভরতা ও পরাধীনতার সমস্যাকেও ভাসাভাসাভাবে দেখে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। আমরা কাগুজে উন্নয়নতত্ত্বের কথা বলছি না, বলছি বাস্তব উন্নয়ন-কর্মকা-ের কথা। মানুষের ব্যক্তিত্বের অবস্থা, সামাজিক সংহতি (integration) শিথিলতা (alienation) এবং অবক্ষয় ও নৈতিক পতনশীলতা, দুর্বল জাতিসমূহের জাতীয় হীনতাবোধ (national inferiority complex) আর প্রবল জাতিসমূহের জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ববোধ (national superiority complex) ইত্যাদি বিষয়কে বিবেচনায় আনা হয় না। উন্নত আর্থিক জীবনের মতো উন্নত মানসিক জীবনও যে অর্জনসাধ্য, প্রয়াসসাধ্য ব্যাপার- এই উপলব্ধি দুর্বল রাষ্ট্র সমূহের উন্নয়নচিন্তায় ও উন্নয়ন-কর্মকান্ডে দুর্লভ।

উন্নয়নবিদেরা যে motivation -এর বা উদ্বুদ্ধকরণের কথা বলেন, বাস্তবে তা অত্যন্ত স্থূল ও অকিঞ্চিৎকর। জাতীয় জাগরণের বিষয় উন্নয়নবিদেরা কখনো বিবেচনা করেন না। কোনো জাতির কিংবা জনগোষ্ঠীর উন্নত আর্থিক জীবন প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য পূর্বশর্ত রূপে সব সময়েই উন্নত মানসিক প্রস্তুতি দরকার হয়, এবং মানসিক প্রস্তুতির ব্যাপারটাও অনায়াসসাধ্য নয়। প্রচলিত উন্নয়নচিন্তায় সমস্যা ও সম্ভাবনাকে ইতিহাসের দিক থেকে- উদ্ভব, বিকাশ ও সম্ভাব্য পরিণতির দিক থেকে- বিবেচনা করা হয় না। ইতিহাসকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয় না। কেবল অংশ নিয়ে চিন্তা ও কাজ করা হয়, সমগ্রের কথা ভাবা হয় না। প্রচারে যাই বলা হোক, আসলে সমাজের নিম্ন-পর্যায়ের নব্বই শতাংশ লোককে উচ্চ পর্যায়ের দশ শতাংশ লোকের হীন স্বার্থ সাধনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য প্রকল্প তৈরি করা হয়। ফলে প্রকল্পের স্বাভাবিক বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য অবলম্বন করতে হয় নানা কূটকৌশল।

প্রচলিত উন্নয়নচিন্তায় আকর্ষণীয় নতুন নতুন পারিভাষিক শব্দ ব্যবহারের চাতুর্য আছে, কিন্তু নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও নির্ভরশীলতার চক্র থেকে মুক্ত হওয়ার কার্যকর কোনো চিন্তা নেই। আধিপত্য শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের, আর নির্ভলশীলতা দুর্বল রাষ্ট্রসূহের। কিছু রাষ্ট্রের বেলায় নির্ভরশীলতা এখন পরাধীনতার গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে। পরনির্ভর উন্নয়ন স্বাভাবিক ও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

৭. বাংলাদেশে উন্নয়নচিন্তা ও উন্নয়নবাস্তবতা
বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের উপর নির্ভরশীরতা, আর চলমান উন্নয়নচিন্তা ও উন্নয়ন প্রকল্পের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উন্নতি বা প্রগতি বিষয়ক ধারণা মৃত ধারণায় পর্যবসিত হয়েছে আর আমাদের জাতির স্বকীয়কতাও নিঃশেষিত হচ্ছে। রাষ্ট্র গড়ে উঠছে না। গবেষক ও উন্নয়নকর্মীদের এমনভাবে মগজ ধোলাই করা হয়েছে যে, তাঁদের মনে জাতীয় পরাধীনতার রোধ জাগছে না, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাও দেখা দিচ্ছে না। বাংলাদেশকে জনগণের প্রগতিশীল রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার চিন্তা ও চেষ্টা বাংলাদেশে নেই। জাতীয় জীবনে প্রচলিত উন্নয়নচিন্তা ও উন্নয়ন কর্মকা-ের ক্ষতিকর দিক অনেক। গরিব রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান দুরবস্থা বহুলাংশে পরনির্ভর উন্নয়নচিন্তা ও উন্নয়ন-কর্মকা- দিয়ে তৈরি। অর্থনীতিবিদদের চিন্তা সম্পূর্ণ পরিনর্ভর। নানা কূটকৌশলে বাংলাদেশে পরাধীনতার পক্ষে রাত-দিন ওকালিত করেন এমন সুশীল, সুজন, বিশিষ্ট নাগরিক বাংলাদেশে নিতান্ত কম নেই। এই উন্নয়নে দারিদ্র্যকে পরিণত করা হয়েছে পশ্চিমা মহাজনি ব্যবসার পণ্যে। এই প্রক্রিয়া মোটেই একপাক্ষিক নয়, এতে উত্তমর্ণ ও অধমর্ণ আছে। অধমর্ণরা মেনে নিচ্ছে বলেই উত্তমর্ণরা এটা চালিয়ে যেতে পারছে। সব দোষ কেবল উত্তমর্ণদের নয়। ক্রমে অধর্মণরা আত্মশক্তিতে বিশ্বাস হারিয়েছে। দুর্বল জাতিগুলোর মধ্যে জাতীয় হীনতাবোধ জাগিয়ে রাখার জন্য প্রবল জাতিগুলো সব সময় তৎপর থাকে। এ ব্যাপারে দুর্বল জাতিগুলোর মধ্য সচেতনতা নেই।

সামাজিক অসামঞ্জস্য ও শিথিলতা (alienation), দারিদ্র ও প্রাচুর্যের দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা- হিংসা-প্রতিহিংসা, জুলুম-জবরদস্তি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা ইত্যাদির স্বরূপ বোঝার জন্য অর্থনৈতিক বাস্তবতার মতোই মানসিক বাস্তবতার বিবেচনা ও গুরুত্ব অপরিহার্য। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক (negative) প্রবণতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রবল। যাঁরা ইতিবাচক (positive) প্রবণতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন, তাঁরা কথিত দাতাগোষ্ঠী বা কথিত উন্নয়ন-সহযোগিদের হয়ে কেবল নিজেদের স্বার্থে কাজ করেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি নিতান্তই আত্মকেন্দ্রিক, সঙ্কীর্ণ- জাতীয় স্বার্থ ও জনস্বার্থের পরিপন্থী। পারস্পরিক অনাস্থা, অবিশ্বাস, জুলুম-জবরদস্তি, গুম, হত্যা, ব্লাকমেইলিং এবং খারাপ আইন-কানুন প্রবর্তন ইত্যাদির ভিত্তিতে চলছে সমাজ। সাধারণ মানুষের মধ্যেও উন্নত চেতনার পরিচয় নেই। এই মানুষেরা নিজেরা, নিজেদের শক্তিতে, নিজেদের জন্য উন্নত অবস্থা সৃষ্টি করবেÑ এটা ভাবতে পারে না। বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে, জাতীয় সংসদে, সিভিল সার্ভিসে, বিচারকদের মধ্যে, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাঁরা যুক্তরষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হয়েছেন। এর চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক আছেন যারা ছেলে-মেয়েদের ওইসব দেশের নাগরিক বানিয়েছেন। এঁদের অনরাগ মূলত বাংলাদেশের প্রতি না ওইসব  দেশের প্রতি? বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণ কালে বাংলাদেশের প্রতি কি এঁরা অনুগত থাকেন উন্নত ভবিষ্যত সৃষ্টির জন্য জাতীয় উন্নতির সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উন্নত চরিত্রের প্রগতিশীল নেতৃত্ব অপরিহার্য। আদর্শ, কর্মসূচি ও কর্মনীতি অপরিহার্য। উনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা ভাষায় জাতীয় উন্নতির সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত হয়েছিল। তারই ফলে সম্ভব হয়েছিল ব্রিটিশ-শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা অর্জন, জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ সাধন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। তখনকার লেখকদের ও রাজনীতিকদের রচনাবলি পড়লে এটা বোঝা যায়। লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি এখনকার লেখদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেক ভিন্ন ছিল। রাজনীতিও তখন অনেক উন্নত ছিল। বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক উন্নতির সেই ধারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে সার্বিক বিশৃঙ্খলার মধ্য পড়ে যায়। ১৯৮০-র দশকে এনজিও ও সিভিল সোসাইটি অরগেনাইজেশনের বিস্তারের পর রাজনীতির প্রকৃতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। রাজনৈতিক আন্দোলনকে পরিণত করা হয়েছে কেবল সরকার উৎখাতের ও ক্ষমতা দখলের ‘এক দফা’ আন্দোলনে। গণতন্ত্রের ধারণাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনে। জনজীবনের সমস্যাবলির সর্বমাত্রিক রূপ আর নেতৃত্বের বিবেচনাকে বাদ দিয়ে যাঁরা সাম্রাজ্যবাদীদের দেওয়া উন্নয়নতত্ত্ব নিয়ে উন্নয়নকাজ করছেন, সমাজরূপান্তরের প্রচার চালাচ্ছেন, তাঁদের ভূমিকা, আর যাই হোক, প্রগতিশীল নয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক অগ্রগতির ধারা পর্যবেক্ষণ করলেই এটা বোঝা যায়। যারা জন্মগত ভাবে বাংলাদেশের নাগরিক এবং পদস্থগতভাবে বিদেশের নাগরিক, যাঁরা ছেলে-মেয়েদের বিদেশের নাগরিক বানিয়েছেন তাঁদের পরিচালনায় বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে গড়ে উঠবে না।

এদেশের নীতিনির্ধারক চিন্তার বেলায় ইঙ্গ-মার্কিন আধিপত্যনীতি ও তাদের দর্শন-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে অভিন্ন ভাবা হয়। বৃহৎ শক্তিবর্গের দিক থেকে উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের নামে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ইঙ্গ-মার্কিন আধিপত্যনীতি, কূটনীতি, প্রচারনীতি, গোয়েন্দানীতি ও বাণিজ্যনীতি কার্যকর করা হয়। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম ও সাম্রাজ্যবাদী ধারার গবেষণাকর্মের দ্বারা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষিতসমাজে চিন্তা-ভাবনার মানসভিত্তি এভাবেই তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে একাডেমিক রিসার্চ বলে যেসব কর্মকা- চালানো হয়, সেগুলোতে কেবল methodology-তে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং বিষয়বস্তুকে গৌণ ভাবা হয়। সেগুলো সম্পূর্ণ যান্ত্রিক, আন্তরিকতাহীন ও সৃষ্টিবৈরী। সেগুলো ব্যবহৃত হয় মূলত সাম্রাজ্যবাদি স্বার্থে।

সুস্থ জাতীয় রাজনীতির প্রত্রিয়ায় থাকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জনজীবনের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির আদর্শ, পরিকল্পনা, কর্মসূচি ও কর্মনীতি। রাজনৈতিক দল ও সরকার তা প্রণয়ন ও অবলম্বন করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন দল স্বাধীন বিবেচনা অনুযায়ী জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় উন্নতির জন্য বিভিন্ন আদর্শ, পরিকল্পনা, কর্মসূচি ও কর্মনীতি গ্রহণের সুযোগ লাভ করে। সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে অনেক কিছু খারাপও থাকে। তবে ত্রুটি-বিচ্যুত ও স্খলন-পতনের মধ্যেও জাতীয় ঐক্য ও জনজীবনের উন্নতির লক্ষ্য থেকে কেউ বিচ্যুত হন না। কোনো সরকার বা দল বা ব্যক্তি যদি তা থেকে বিচ্যুত হন, তাহলে জনসমর্থন হারান ও ক্ষতির মধ্য পড়েন।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পরিকল্পনা অনুযায়ী দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে যেভাবে উন্নয়ন-প্রকল্প গৃহীত হয় তাতে অনেক কিছু স্থানীয় অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না এবং সেগুলোতে দুর্নীতির সুযোগ থাকে। কখনো কখনো রাষ্ট্রের সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে বিদেশি অর্থলগ্নিকারী সংস্থা সমূহের বিরোধও দেখা দেয়। এই বিরোধে সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহকে অর্থলগ্নিকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে চলতে দেখা যায়। অর্থলগ্নিকারী অরগেনাইজেশনের সংস্থা সমূহ মূলত পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের মালিকানাধীন। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে অর্থ ব্যয় করে তারা তাদের স্থানীয় সহযোগী শক্তি তৈরি করে, অর্থলগ্নিকারীরা প্রবল পক্ষ হওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের কথিত উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় পড়ে দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের রাজনীত অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিপর্যস্ত ও বিকৃত হয়। বাংলাদেশে ভয়ানকভাবে এটা হয়েছে। অর্থলগ্নিকারী রাষ্ট্র ও সংস্থা সমূহ কর্তৃত্ববাদী নীতি অবলম্বন করে দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা-সংস্কৃতিগত সকল ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে- কর্তৃত্ব করছে। নিঃরাজনীতিকরণের ও নিঃষ্ট্রকরণের (anarchism) কার্যক্রমও চালাচ্ছে।

মোটামুটি এই হল আজকের উন্নয়ন সংক্রান্ত বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে খুঁজতে হবে আত্মশক্তি বৃদ্ধির ও স্বাধীনভাবে চলার উপায়। এর জন্য দরকার প্রগতির বা উন্নতির ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত, নবায়িত, বিকশিত ও কার্যকর করা, এবং জাতীয় রাজনীতিকে সুস্থ, স্বাভাবিক স্বাধীন ও শক্তিশালী করা। উন্নয়নের ধারণাকে পুনর্গঠিত করে নিজেদের স্বাধীন বিবেচনা অনুযায়ী উন্নতির বা প্রগতির ধারণার অর্ন্তভুক্ত করে নিতে হবে। পুনর্গঠিত ধারণা অনুযায়ী উন্নয়নের পরিকল্পনাকে হতে হবে উন্নতির বা প্রগতির কর্মধারার অংশ। এর জন্য নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণের ঐক্য অপরিহার্য। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিই আজকের বিশ্বব্যবস্থার নিয়ামক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যবস্থা যে রূপ লাভ করেছে, তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সমন্বিত রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে বিশ্বায়ন। জনগণের দৃষ্টিতে পৃথিবীর উপর কর্তৃত্ব করার কোনো রকম নৈতিক অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের নেই। দুষ্কর্মের পরিণতিতে যে কোনো শক্তির পতন অনিবার্য হয়। জাতীয় চিন্তার সম্পূরক রূপে উন্নততর নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তাও অপরিহার্য।

চিন্তার সঙ্গে লাগবে কাজ। শুধু চিন্তা দিয়ে হবে না। শুধু কাজ দিয়েও হবে না। চিন্তা ও কাজ দুইই লাগবে।

(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here