এবিএম সোহেল রশিদ # লেখক ড. মোশাররফ হোসেন একজন সফল রাজনীতিবিদ। শিক্ষক হিসেবেও তারঁ সুনাম সর্বজন স্বীকৃত। তার বইয়ের ভূমিকাতেই তার কিছু সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করলেও বইটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে ঋদ্ধ অভিজ্ঞতা, শিক্ষকতার পা-িত্য ও রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাতের কলমচিত্র সাবলীল ভাবেই উপস্থাপন করেছেন। বর্ণনাধর্মী হলেও বইটি কলমরসে উত্তীর্ণ চলমান সময়ের স্মারক দলিল একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সরলোক্তির মাধ্যমে তিনি স্বীকার করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, একগুঁয়েমি, সহিংসতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং চলমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির ফলে বাংলাদেশে এক-এগারোর সৃষ্টি হয়েছিল । এখানেই একজন রাজনীতিক হিসেবে তিনি আবারও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। বইটির দালিলিক মূল্যও যাতে থাকে সেদিকে তার বিশেষ দৃষ্টি ছিল, তা সহজেই অনুমেয় ।
তার কলম একজন ইতিহাসবিদের মতো সত্যানুসন্ধানী। সহজ সরল কিন্তু অন্তর্ভেদী বর্ণনায় পাঠককে তার জেলখানার ৬১৬দিনের রোজনামচায় একাকার করে ফেলেছেন। এখানেই একজন লেখকের সার্থকতা। নারীদিবসে একজন নারী; যিনি রাজনীতিবিদ- সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাইরেও একজন মমতাময়ী মা তার উৎকণ্ঠা দিয়ে এই বইয়ের সূচনা করেছেন। সময় ও বিষয় নির্বাচনে এই বিবেচনাবোধই পাঠককে বইটি পড়তে আগ্রহী করবে। তৃতীয়বারের মতো গ্রেফতারের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক ১/১১ অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকা- সোজাসাপ্টা পাঠককে জানিয়ে দিয়েছেন। সেই সময়ের কারাগারের পরিস্থিতি, পত্রপত্রিকার ভূমিকা, কারাবন্দী রাজনীতিক সহকর্মীদের কাছ থেকে কারাগারর ভিতরের সহযোগিতা ও দেশকে নিয়ে কারা-ভাবনার একটা সংক্ষিপ্ত সাদা-কালো চিত্র আঁকার চেষ্টা পুরো বই জুড়েই লক্ষণীয়।
বাড়তি পাওনার মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের দৈনন্দিন জীবনচিত্র। হাস্যরস ও সুখ-দুঃখের কলমচিত্রে অনেক অজানা তথ্যও জানা গেছে। উঠে এসেছে ২০০৭ সালের ২০ আগস্টের ছাত্র-সেনা সদস্যের সংঘর্ষের খবর। মূলতঃ এই ঘটনাই মানুষকে প্রতিবাদী হতে সাহস যোগায়। ১/১১-এর কুশলীবরা তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে বাধ্য করে বলে অনেক বোদ্ধারা মনে করেন। বইটিতে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সামরিক জান্তাদের কুটকৌশলের পরিকল্পনাগুলো জেলখানায় বন্দী রাজনীতিবিদদের মাঝে যেভবে বিশ্লেষিত হয়েছে তার একটি খ-চিত্রও উঠে এসেছে।
ষড়যন্ত্রের পরম্পরায় ১৯৮৬ সালের এরশাদীয় নির্বাচনের পোস্টমর্টেমও আলোচনা করা হয়েছে। ৬১৬ দিনের অনেক তথ্যই ইতিহাসবিদদের কাজে লাগবে। কারাগারের ভিতরে সব দলের নেতারা যে রাজনৈতিক সহমর্মিতা ও সম্প্রীতি দেখান তা যদি মুক্ত মৃত্তিকার মানুষের সম্মুখে দেখাতে পারতেন, তা হলে আরও ভালো লাগতো। লেখনীতে সাধারণ কয়েদিদের সাহায্য সহযোগিতা, তাদের রাজনৈতিক ভাবনা, রাষ্ট্র নিয়ে তাদের দর্শন, জুনিয়র রাজনীতিকদের কারাগারের তিক্ত অভিজ্ঞতা, রাজনীতিকদের নিয়ে তাদের ভাবনাগুলোও যদি আরও বিস্তারিতভাবে উঠে আসতো তাহলে নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের জন্য আরও শিক্ষণীয় হতো। আশা করছি, তৃতীয় সংস্করণের সময় অথবা আরেকটি বই লিখে তিনি তার সেই রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করবেন।
ড. খন্দকার মোশারফের ‘ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের কারাগারে ৬১৬ দিন’ এ প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের জন্য শিক্ষনীয়। বইটি নবীন প্রবীণ রাজনীতিবিদদের পড়া উচিত। লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকেই নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। জানতে হবে, রাজনীতিতে কোনটা গ্রহণীয় আর কোনটা বর্জনীয়। ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার রেওয়াজ না থাকলেও শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা এখনই শুরু হোক। বইটির বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।
সুন্দর নামকরণ, নান্দনিক প্রচ্ছদ ও সহজ সরল বর্ণনা রীতি বইটিকে সুখপাঠ্য করেছে। লেখক হিসেবে সহজেই পাঠকের মননে প্রবেশের মুন্সিয়ানা ঈর্ষনীয়ও বটে।
সংক্ষিপ্ত বই পরিচিতি-
বই : ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের কারাগারে ৬১৬ দিন
লেখক : ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন
উৎসর্গ : সেই সময়ের নির্যাতনের শিকার লেখকের পরিবারে সকল সদস্য সহ আইনি লড়াইয়ে সহযোগিতাকারী এডভোকেটবৃন্দ
প্রচ্ছদ : জাহিদ হাসান বেণু
অনুচ্ছেদ : ২৮টি
প্রকাশক : মোহাম্মদ সহিদুল ইসলাম
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান : জ্ঞান বিতরণী
প্রথম প্রকাশ ২০১৩
দ্বিতীয় প্রকাশ : ২০১৪
পৃষ্ঠা : ২৬৪
মূল্য : ৪০০ টাকা