আমাদের বাঁচার জন্য সুন্দর একটা জীবন চাই। পরীক্ষিত-নিরীক্ষিত জীবন। সক্রেটিসের একটা বিখ্যাত উক্তি দিয়ে কথাটা খোলাসা করা যায়: ‘The unexamined life is not worth living. একটা অপরীক্ষিত বা অনিরীক্ষত জীবন বাঁচার জন্য নয়। মহত্তর ব্যক্তিত্বদের জীবন আসোলে এক একটা আলোর ভূমিকা মাত্র। তারা আলোর প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঘটিয়ে যান সত্যের ও বিশুদ্ধতার বিচ্ছুরণ। সক্রেটিসও তাঁর জীবনের আলোর সন্ধান পেয়েছিলেন তার মৃত্যুর ভেতরেই। যে-মৃত্যু সুন্দর, যে-মৃত্যু মহত্তর- সে মৃত্যু তো জীবনের মতোই সাবলিল, স্বচ্ছতর আলোর পারদ। সেখানে জীবন এবং মৃত্যুকে সমান স্পষ্ট করে দেখা যায়। যে-চেতনা থেকে মানুষের জীবন ও আচরণ বিবর্তিত ও বিচ্ছুরিত হয়, সেটাই তো মানুষের জীবন। স্রষ্টার সৃষ্টিজগতের ভেতর মানুষেরাই কেবল আলোকপ্রাপ্ত সত্তা। শুনেছি, কিন্তু দেখিনি- সশরীরী জ্বিনেরাও নাকি আলোর সত্তার অধিকারী। আলো যেমন অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে, বিকীর্ণ করে সহস্র ছটায় এবং নাগালের ভেতর বস্তুপুরুকেও আলোকিত করে; আর সে নিজেকেও প্রকাশ করে সহস্র ধারায়। এটাই আলোর স্বভাব। আর ভাস্বর ধর্ম।
আলোর অস্তিত্ব তো তার শাশ্বত স্বভাবের মধ্যে বিম্বিত। আলোকে অন্ধকার গ্রাস করতে পারলে আলোর টিকে থাকাই দায় হতো। কিন্তু আলো তার শক্তি-স্বভাব-ধর্মে পরীক্ষিত-নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠিত। আলোকে তার নিজের ভূমিকা থেকে প্রকৃতির রাজ্যের সুন্দর মোহন অবস্থান থেকে কোনো ‘অশুভ শাসন’ পরাস্ত করতে পারে না। একটুও সরাতে পারে না, কোনো দিকে কোনো বিন্দুতে। আলো অন্ধকারের খোলস বিকীর্ণ করে অন্ধকারে অবস্থানকৃত বস্তুনিচয়কে দেখাতে পারে। আলো জ্বলে উঠলে আলোর পিদিমটাকেও আমরা দেখতে পাই। আলোর জ্বলে না-ওঠা পর্যন্ত ‘সোনার প্রদীপ’ টাকেও আমরা দেখতে পারি না। আলোর আবির্ভাবের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত ওই অন্ধকারের বিবরে পড়ে থাকে, ব্রোঞ্জের নিরেট প্রদীপখানা। দ্বীপমালার দেদীপ্যমানতা নির্ভর করে আলোর জ্বলে ওঠার মধ্যে। অর্থাৎ আলো শুধু আলো নয়- আলোর পরিচয় আলোর ভূমিকা পালনে। তাই বলছিলাম, জীবনের যোগ বা যজ্ঞ জীবন নিরীক্ষণে, জীবন সন্দর্শনে। এর বাইরে জীবনের আর কোনো ভূমিকা নেই। জীবন যখন পরিপার্শ্ব ও বস্তুকে দেখতে পারে- তখন যেন জীবনটাকেই বড়ো বেশি করে দেখা হয়ে যায়, আলো দিয়ে জীবনকে দেখা, সবকিছুকে দেখা যায়। জীবনও দেখতে পারে আলোকে শতচ্ছটায়- এখানেই জীবন ও আলোর সম্পর্ক বিশদ, বিস্তর। আলো যখন কারোর জীবনের অন্দরমহলে প্রবেশ করে জীবনও তখন মিশে যায় আলোর সংগে। আলো হলো ‘চেতনা’, সত্ত্বা অস্তিত্ব চেতনা থেকে ‘যুক্তি’। আর যুক্তির উৎসারণ হলো ‘কর্ম’। এই কর্মযোগেই মানবজীবন সংগঠিত সমৃদ্ধ। বার্ট্রান্ড রাসেলকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হলো: Does an Agnostic deny that Man has a soul? রাসেল জবাবে বললেন :
“This question has no precise meaning unless we are given a definition of the word, “Soul.”
Suppose what is meant is, roughly, something non material that persists throughout a person’s life and even, for those who believe in immortality, throughout all future time. If this is what is meant, an agnostic is not likely to believe that man has a soul.
But I must hasten to add that this does not mean that an agnostic must be a materialist. Many agnostics (including myself) are quite as doubtful of the body as they are of the soul, but this is a long story taking one into difficult metaphysics.
Min and matter alike, I should say, are only convenient symbol, discourse, not actually existing things.”
জগতের ‘চরম তত্ত্ব’ অজ্ঞাত বা অক্ষেয় এই মত যাদের আচ্ছন্ন করে রাখে তারা অক্ষবাদী (agnostic)। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাইরে কিছু থাকলেও সেটা মানুষের পক্ষে জানা অসাধ্য এই মতবাদ।
মানুষ তার দেহ-কাঠামোর ভেতর যা স্পন্দমান- সেটুকু সে অনুমান ও অনুধাবন করতে পারে। দেহকাঠামোর ভেতরেই যে প্রাণশক্তি বিন্দু অবস্থান করে- তার অস্তিত্ব, অনিবার্য অবস্থান কিংবা তার চূড়ান্ত উপস্থিতি সম্পর্কে মানুষের ধারণা কখনো অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ প্রহেলিকাময়। ‘আত্মদর্শন’, ‘আত্মজিজ্ঞাসা’, অর্ন্তদর্শন, এই অধিক্ষান যুগ যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী মনুষ্যকুলকে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলছে। কোনো কুলকিনারা যেন খুঁজে পাচ্ছে না। সে জীবনের পরমার্থ সাধন ছাড়া জীবনের অর্থই বা কতোটুকু? এই ‘স্পিরিচুয়ালিটি’ (spirituality) তার চিন্তার জগতকে কতোবারই না আন্দোলিত করে তুলছে।
এই ‘সোল (soul)’, এই ‘আত্মা’, এই ‘অহং’, এই ‘রুহ’, এই ‘নাফ্স’ দেহ-কাঠামোর কোন্ কুঠুরিতে অবস্থান করে? ওই কুঠুরির সব প্রান্ত সব ভাঁজ উন্মোচন করে কী আত্মার আলোর ‘বিভা’ দৃশ্যমান করে তোলা যায় না? আত্মা কি কোনো ‘বস্তু’ না ‘অবস্তু’? সজ্ঞাবাদীরা কী এ ‘চিত্তোজ্ঞ’ ‘রুহানির’ সত্য-দর্শন করছেন?
‘পরমাত্মা’ ‘অমরাত্মা’র সত্যানুসন্ধান করছেন? নাকি কেবল অক্ষেয়তা আর সন্দেহের ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হচ্ছেন?
অক্ষেয়বাদীরাই কি নির্জেয়সন্ধানী, আলোকদৃষ্টির অধিকারী। এসব প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে সমকালীন চেতনা ও জীবনবোধের সামনে।
এ মানুষের জীবনের চূড়ান্ত প্রশ্নটি কী? চূড়ান্ত প্রশ্নটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময়ই বা কোথায়, আজকের এই প্রগতি প্রপীড়িত মানুষদের? আমরা পৃথিবীতে কখন এলাম? কেন এলাম? কীভাবেই বা এলাম, কেই বা পাঠালো আমাদের এখানে, এ মর্ত্যভূমে? স্বর্গে তো কুশলেই ছিলেন আদম এবং হাওয়া মানবজাতির ‘আদি পিতা’- প্রথম মানব। প্রথম পুরুষ। ‘আদি মাতা’ প্রথম মানবী। প্রথম রমনী। আমাদের চিন্তার ও চেতনার রাজ্যটিও যে কতো রহস্যময় সেটা আমরা নিজেরাও সম্যক উপলব্ধি করতে পারি না। আমাদের ‘অজ্ঞতা’ এবং অজ্ঞেয়তা কোনোটাই কম নয়। আমরা এ বিষয়ে, জীবনের এ গুঢ়তায় অংশগ্রহণ করতে পারলে নিজেদেরই হয়তো উপকৃত করতে পারতাম। বলুন তো, আমরা নিজেরাই কি নিজেদের নিজস্ব কোনো শক্তিতে এ পৃথিবীতে চলে আসার সৌভাগ্য লাভ করেছি? আবার এ পৃথিবী থেকে একা এবং একার শক্তিতে চলে যাবার কোনো শক্তিই কি আমরা অর্জন করেছি? প্রশ্নটা কেমনতর জটিল হয়ে গেলো। আমাদের আসা-যাওয়ার ব্যাপারটা আমাদের এখতিয়ারে নয়, মোটেই। আমরা আধেয়-সৃষ্টি। আর মহা আধার হলেন স্রষ্টা। সৃষ্টি কেন স্রষ্টার সন্ধান করবে? স্রষ্টাকে খোঁজার ভেতর কোনো সার্থকতা আছে কি তার? স্রষ্টারই বা দায় কিসের? দায় উভয়েরই হয়তো আছে। সৃষ্টির দায়ই অধিকন্তু বেশি। ভিন্নমতধর্মীরা আমার এ কথা থেকে কোনো সীমান্তবর্তী রেখা টানবেন না, আশা করি। আমরা যদি আমাদের সৃষ্টিকর্মের সন্ধান করতে পারি। তাহলে সৃষ্টির স্রষ্টা, স্রহাস্রষ্টা আমাদের সন্ধান করবেন না কেন? স্রষ্টার প্রতি মানুষে বিশ্বাস করবেন না কেন? স্রষ্টার প্রতি মানুষের বিশ্বাস একেবারেই, অর্থাৎ সর্বাংশেই প্রকৃতিজাত।
এখানে জোর জবরদস্তির কোনো ব্যাপার নেই। স্রষ্টার প্রতি অমনোযোগ প্রদর্শনে সৃষ্টির কোনো লাভ আছে কিনা আমার জানা নেই। বরং এ থেকে নিজের অস্তিত্ব, বিশ্বাস এবং ভালোবাসার নির্বাসন ঘটে যেতে পারে। স-শান্তির ‘কৃষ্ণাঙ্গি’ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পারে নিজেরই অন্তর্গৃহে। আর বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয় চেতনার হর্স্যপ্রসাদে; অন্তহীন আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও ভালোবাসা লড়িয়ে তা উঠতে থাকবে গুল্মলতা এবং শ্যামকান্ত উদ্ভিদের মতো। স্রষ্টার আকাঙ্ক্ষা, স্রষ্টার স্বপ্নই- মানুষের আকাঙ্ক্ষা, মানুষের স্বপ্নের বীজকণ্যা।
‘বস্তু’র সঙ্গে ‘অবস্তুর’ সম্পর্ক বিস্তর। ‘জড়সত্তা’ কেবল অজড়সত্তার সঞ্চালনে মূল্য পেয়ে থাকে। এ মূল্য চিরকালই থেকে যাবে। বিশেষ করে কতোগুলো মৌলিক ‘উপাদান’ ‘প্রক্রিয়ায়’ যে বস্তু বিষয়ের সৃষ্টি- সেগুলোর একটি চিরন্তন মূল্য রয়ে গেছে। মানুষের বুদ্ধি, জ্ঞান, শক্তি ও মেধা ও প্রযুক্তিজাত যে বস্তুপুঞ্জ এসবের ‘মূল্য-বিচার’ (value judgement) ভিন্ন ধরনের। বর্তমান সভ্যতার আঁতুরঘর তো বস্তু, বস্তু আর বস্তু। বস্তুর সভ্যতা।
সভ্যতাপীড়িত এ মানব সমাজের মুক্তি কোথায়? ‘বস্তুতে’ না ‘বিশ্বাসে’? বস্তুর বোধ তো বিশ্বাসের অন্তরায় নয়। ‘অবস্তুর’ বিশ্বাসের সীমারেখা কোন মেরুসন্ধিতেই বা? আমার এ কথা বলা কোন তর্কের কুটজাত বোনা নয়। আমি তর্কের বিষয় আসয়কে তর্কাতীত করে তোলার প্রয়াসী। আগামীকালের, ভবিষ্যতের, ভাবুকদের ‘শরণ’ গ্রহণ করতে চাই। তারা বস্তুকে অ-বস্তুর ভেতর সংস্থাপনা করে নবতর চেতনার উন্মেষ ঘটাতে উদ্যোগী হবেন। বস্তু ও অবস্তুর রহস্যটা কী? একবার চোখের পাতা উন্মোচন করে দেখে নিতে পারি না কি আমরা? আমরা আমাদের সমুদয় শক্তি সংযোজন করে বিশ্বলোকের আরও অসংখ্য সম্ভাবনাকে দিগন্তের মতো মেলে ধরতে পারি।
আমরা কেন আমাদের চিন্তা, কর্ম ও অধ্যাত্ম সাধনায় অনশ্বর প্রেমকে খুঁজে পেতে পারবো না। এ প্রসঙ্গে আমি একটি ফার্সি ক্যানডার উদ্ধতি লিপিবদ্ধ করছি :
আমরা যদি আমাদের ভেতরকার চোখগুলো ব্যবহার করে পারতাম, তাহলে এক অভাবনীয় আলোকসত্তার বিচ্ছুরণ হতো আমাদের ভেতরে-বাইরে।
‘Your inward eye
never opens-
no wonder, therefore,
the secret remains hidden
from your heart.’
চামড়ার চোখ দুটো, হামেশাই খোলা, আমাদের। কিন্তু ভেতরের চোখ দুটো? ওই চোখগুলো কি কখনো খুলতে পারবো না আমরা? রহস্য কেবল রহস্যই থেকে যাবে? উন্মোচন করতে পারবো না হৃৎ-ভূমির এক তিল পরিমাণ মাটিও!
আমার বাঁচার জন্য যে জীবন, সেই জীবনের বিপুল বিকাশের জন্য ভেতরের চোখ দুটো অন্তত: একবার খোলা প্রয়োজন। অন্ততঃ একবার।