আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, একই সাথে সমাজের একটি দূর্বল অংশও বটে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলাদেশে আশংকাজনক হারে বাড়ছে শিশু নির্যাতন। বাড়ছে শিশুর প্রতি সহিংসতা, অমানবিক বর্বরোচিত ঘটনার মধ্য দিয়ে শিশুকে নির্মম ও বিকৃত মধ্যযুগীয় পন্থায় হত্যা করা হচ্ছে। সম্প্রতি, একসাথে চার শিশুকে মেরে লাশ বালুচাপা দেয়ার ঘটনাটি জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ে একের পর এক শিশুর উপর নির্মম ও বর্বরোচিত কায়দায় নির্যাতনের পর হত্যা এবং সহিংসতাকে বিশ্লেষকরা দেখছেন সমাজের ভয়াবহ চরিত্রের এক একটি দিক হিসাবে। বলাবাহুল্য, এই নির্মম ঘটনার শিকার দেশের নিন্মবিত্ত পরিবারের শিশু ও গৃহকর্মী শিশুরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখনো যেন আমাদের সমাজ সভ্য হয়ে উঠেনি।
একটি সভ্য দেশের মানুষ হিসাবে প্রতিটি মানুষেরই অধিকার রয়েছে সম্মান ও পরিপূর্ণ মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার। হোক সে দরিদ্র, নারী কিংবা শিশু। কিন্তু প্রতিদিন আমরা কী দেখছি এ দেশে? নারী নির্যাতন আর ধর্ষণের মত চরম ভয়াবহতায় রয়েছে আজ আমাদের শিশুরা। সারা বিশ্বে সকল প্রকার সহিংসতা থেকে নারী ও শিশুদের নিরাপদে রাখার কথা বলা সত্বেও বর্তমান বিশ্ববাসীদের মধ্যে একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়, যা শিশু অধিকার সর্ম্পকে পূর্বেকার যে কোন সময়ের চেয়ে আরো আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। কতটা বিবেকহীন হলে কোমলমতি শিশুদের উপর নির্মমভাবে ঝাপিয়ে পড়তে পারে মানুষ, ভাবতে গা শিউরে উঠে।
শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সামাজিক সচেতনাতার বৃদ্ধির বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের সকল স্তরের মানুষকে শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একটি শিশুর কান্না কি আমাদের মানবত্মাকে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি করেনা? কতটা নির্মমভাবে শিশু রাজনের উপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে, ভাবলে সভ্য সমাজে মুখ ঢাকারও জায়গা নেই যেন। অতঃপর শিশু রবিউল এবং সর্বশেষ শিশু রাকিবের মলদ্বারে কমপ্রেসার মেশিন ঢুকিয়ে পেটে বাতাস ভরে নির্মম নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। উঃ বিধাতা, ভাবতে ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। সত্যি কি আমরা মানুষ! নাকি মানুষরূপী কোন প্রেতাত্মা আমাদের উপর ভর করেছে। এভাবে একের পর এক নারকীয়ভাবে শিশু হত্যা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার উপর শুধু নেতিবাচক প্রভাবই নয় বরং গোটা ভয়াবহ চরিত্রের একটি দিক হিসাবে দেখছেন অভিজ্ঞ মহলেরা।
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে সরকার এ দায়কে কোনভাবে এড়াতে পারেনা। মানুষের ভিতরে আজ চাপা ক্ষোভ, নীরব আন্দোলন, কোথাও থিতু হতে পারছে না। তাই হয়তো মানুষ ভিতরে ভিতরে মানসিকভাবে পঙ্গু, অস্থির, দিশেহারা। আর এই অস্থিরতা ও মানসিকভাবে পঙ্গুত্বের কারনে মানুষ আজ সংগঠিত হতে পারছেনা। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে। কোথায় যাবে, কোন পথে যাবে বুঝতে পারছেনা। এভাবে একের পর এক নির্মমভাবে শিশু হত্যা সাধারণ মানুষের বিবেককে করেছে স্তব্ধ। সুশীল সমাজের বিবেককে করেছে কলুষিত।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিন বছরে এক হাজার ৭৩০ টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। তবে, কতজন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে তার হিসেব এই মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। আইন ও সলিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব মতে, ২০১৩ সালে অন্ততঃ ১০০ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৮ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যাদের বয়স ৭-১২ বছরের মধ্যে। শারীরিক নির্যাতনের পর মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। অন্যান্য নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ৩২ জনের। শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুছ সহিদ মাহমুদের তথ্য মতে, এ বৎসর জানুয়ারী থেকে জুলাই এই সাতমাসে দেশে ১৯১ জন শিশু খুন ও ২৮০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শুধমাত্র জুলাই মাসে খুন হয়েছে ৩৭ শিশু এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫০টি। ১৮ ফেব্রয়ারী ২০১৬ এর প্রথম আলোর তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালে ২০৯ জন শিশু, ২০১৩ সালে ২১৮ জন শিশু, ২০১৪ সালে ৩৬৬ জন, ২০১৫ সালে ২৯২ জন এবং শুধুমাত্র ২০১৬ ফেব্রয়ারী পর্যন্ত ৩৭ জন শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মর্যাদা এবং জাতিসংঘ নীতিমালা ও ঘোষনা অনুযায়ী সমঅধিকারের স্বীকৃতিই হচ্ছে স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার ও শান্তির ভিত্তি। জাতিসংঘের সার্বিক ঘোষনা অনুযায়ী সকল শিশুর প্রাপ্য হচ্ছে বিশেষ যতœ ও সহায়তা। প্রতিটি শিশুকে রক্ষা ও তাদের স্বাভাবিক বিকাশের স্বার্থে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনতে হবে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে আরো বলা হয়েছে, প্রতিটি শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার রাষ্ট্রসমূহ স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু দারিদ্র পীড়িত বাংলাদেশের শিশুরা এমনিতেই রোগে শোকে বিভিন্ন অপুষ্টিতে ভুগে মারা যাচ্ছে, তার উপর এখন শুরু হয়েছে মরার উপর খড়ার ঘা নামক নারকীয় কায়দায় শিশু নির্যাতন করে হত্যা করা।
বলাবাহুল্য, মানব শিশুর অসহায়ত্বে প্রধান দিক হলো, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া। জীবনের প্রথম থেকেই শিশুরা বিভিন্নভাবে বহুমাত্রিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। মানুষের বিকৃত যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করার একটি সহজ সামগ্রী হলো শিশুরাই। শিশুর উপর যৌন নির্যাতন করাটাকে বিকৃত রুচির মানুষেরা নিরাপদ মনে করে। কারণ শিশুরা এর তাৎপর্য বোঝেনা, আবার ভয়ে কারো কাছে বলেও দেয়না। আর বললেও অন্যেরা তা বিশ্বাস করবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, বেশীর ভাগ শিশুই (ছেলে/ মেয়ে) প্রথম যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে তার আপনজন বা নিকট আত্মীয় দ্বারা। সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুরাই সব থেকে যৌন নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে বাস করে।
প্রতিদিন বহুমাত্রিক যৌন সন্ত্রাসের বলি হচ্ছে এদেশের অনেক নারী ও শিশু। এর মধ্যে বেশীর ভাগই পথশিশু ও শ্রমজীবি শিশু। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবিকার সন্ধানে শহরমূখী হবার প্রবণতা শিশুদের অনেককাংশে অনিরাপদ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাবা-মা কাজের সন্ধানে বাইরে গেলে তাদের শিশুদের দেখভাল করার মত কেউ থাকে না। ফলে, নিপীড়নকারীরা সুযোগটির সদব্যবহার করেন।
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দেশে শিশু নির্যাতন ও হত্যাকান্ড বেড়েই চলছে। যখন পাঁচজন একটি শিশুকে নির্যাতন করে তখন পাশে দাড়ানো আরো পাঁচজন প্রতিবাদ না করে হয় চুপ করে থাকে নয়তো হাততালি দেয়। যেকোন অপরাধ দেখে চুপ করে থাকার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। আমরা ভুলে যাচ্ছি- এ দায় একা সরকারের নয়, এ দায় গোটা জাতির। আসলে আমরা মুখে বলছি অনেক ফাঁকা বুলি, কিন্তু কার্যত ফলাফল জিরো। আমাদের প্রতিরোধের ইচ্ছেশক্তি মরে গেছে। বোধের দেয়ালে কালিমা পড়েছে। শৌর্য-বীর্য আর সাহসে পচন ধরেছে। এ কারণে অপ্রতিরোধ্যভাবে চোঁখের সম্মুখে ঘটছে ঘটনাগুলো। এই বলয় থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারলে শিশু নির্যাতন আশংকাজনক হারে বেড়েই চলবে। পাশাপাশি, যারা এসব ঘটাচ্ছেন তাদের খুব একটা জবাবদিহিতার সম্মুখিন হতে হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে অবক্ষয়ের চরম পর্যায়ে পৌছে যাবে দেশ।
সুতারাং আর দেরি নয়, এখনি প্রতিরোধ ও গনআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একের পর এক শিশুহত্যার কারণটি খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে প্রচলিত আইনের সংস্কার করে বিচার ব্যবস্থাকে আরো কঠোর করতে হবে। অপরাধী যেই হোক, যেকোন দলেরই হোক, তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এব্যাপারে সরকারকে আরো অগ্রণী ভুমিকা পালন করতে হবে। আমরা চাইনা দেশের ভবিষ্যৎ প্রতিনিয়ত হায়েনার করালগ্রাসে এভাবে অকালে প্রতিনিয়ত ঝরে যাক। একজন সচেতন মানুষ হিসাবে এ দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলবে না। মানবতাবাদের পৃষ্ঠাতে অপেক্ষারত আর একটি মৃত্যু দেখার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
(কবি, কলামিষ্ট ও নাট্যকার)