মোহাম্মদ অংকন : যে বয়সে তরুণরা ঝুঁকে পড়ে মাদকের দিকে, হয়ে পড়ে ইন্টারনেটে আসক্ত, নষ্ট সমাজের দিকে গা ভাসিয়ে পথভ্রষ্ট হয় কিংবা যে বয়সে তরুণরা জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে ছুটে চলে, বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরে না; ঠিক সেই বয়সে ব্যতিক্রম সব কাজ করে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে চলেছেন নাটোরের তরুণ শেখ রিফাদ মাহমুদ। যার কার্যক্রমের কথা প্রায়ই মূলধারার গণমাধ্যমে আসছে। বয়স খুব বেশি না। সম্প্রতি আঠারো পেরিয়েছে। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে। পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার পণ থাকলেও দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পণটা তাঁর অধিক জোড়ালো। ২০১৭ সাল, যখন কি না তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, সেই তখন থেকে সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবীমূলক কাজের সাথে নিজেকে জড়ান।
এই তরুণ কী কী করে থাকেন, তা জানবো একনজরে–
১. সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ ও তাদের শিক্ষায় তাগিদ দেওয়া, তাদের বাবা মা এবং তাদের সচেতন করা, শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো। করোনাকালে তাদেরকে শিক্ষাসামগ্রী প্রদানসহ সার্বিক খোঁজ-খবর রেখে চলেছেন। এছাড়া শিশুশ্রম বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাবা-মাকে শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে বোঝানো।
২. প্রতিবছর দুটো ঈদে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে নতুন পোশাক উপহার দেওয়ার কার্যক্রম চালু রেখেছেন। শুধু তাই নয়, গরীব-অসহায় পরিবারের মাঝে খাদ্য উপহার সামগ্রী বিতরণও করেন।
৩. পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ রোপণ এবং পথচারীদের মাঝে গাছের চারা উপহার দেওয়া। সবাইকে জলবায়ু রক্ষায় পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন করে তোলা। ২০২০ সালে নাটোর সদর, সিংড়া, নলডাঙ্গা, গুরুদাসপুর উপজেলায় বৃক্ষ রোপন করেন এবং পথচারীদের বৃক্ষের চারা উপহার দেন। এ বছরও তাঁর এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
৪. মাদক, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, যৌতুক-এর বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করছেন। তাদের কাছে বিভিন্নভাবে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। এসবের কুফল সম্পর্কে অবহিত করছেন। কেউ বাল্যবিবাহর সম্মুখীন হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন।
সময়টা ২০২০ সালের মার্চ মাস। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বাংলাদেশে আসার পর থেকেই বিভিন্নভাবে কাজ শুরু করেন শেখ রিফাদ মাহমুদ। মার্চ মাসে নাটোর জেলাব্যাপী করোনা সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করেন। ‘লাল সবুজ উন্নয়ন সংঘ, নাটোর’ শাখার সদস্যদের নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের দিনমজুর শ্রেণির মানুষদের করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে বোঝান। তাদেরকে করোনামুক্ত থাকার উপায় ও করণীয় ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেন। শ্রমজীবী, কর্মজীবী, গরীব ও গ্রাম্য অঞ্চলের মানুষের মাঝে সচেতনামূলক লিফলেটের পাশাপাশি মাস্ক বিতরণ করেন রিফাদ ও তাঁর সংগঠন ‘লাল সবুজ উন্নয়ন সংঘ’। যেখানে তিনি নাটোর জেলা শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শুধু তাই, করোনার কারণে ক্রমাগত লকডাউন শুরু হলেও তিনি বসে থাকেননি। প্রথমে নাটোর শহরের রিক্সা ও ভ্যান চালকের মাঝে চাল, ডাল, আলু, সাবান ইত্যাদি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিতরণ করেন। ২০২০ সালের ঈদ-উল-ফিতরে ৪০০ অসহায়, কর্মহীন মানুষের মাঝে ঈদ-খাদ্য সহায়তা হিসেবে সেমাই, লাচ্চা, চিনি ইত্যাদি বিতরণ করেন। একই সময় নিজ উদ্যোগে গুরুদাসপুর ও সিংড়া উপজেলায় ১১০টি পরিবারের মাঝে ঈদ-খাদ্য সহায়তা হিসেবে সেমাই, লাচ্চা, চিনি ইত্যাদি বিতরণ করেন। করোনাকালে সর্বমোট এক হাজার পরিবারের মাঝে খাদ্য সহায়তা, ঈদ শুভেচ্ছা-খাদ্য পৌঁছে দিয়েছেন নিজ অর্থায়নে ও উদ্যোগে। নিজ উদ্যোগের বাইরেও ‘লাল সবুজ উন্নয়ন সংঘ, নাটোর’ শাখার পক্ষ হতে নাটোর সদর, সিংড়া, গুরুদাসপুরে খাদ্য সহায়তা প্রদান করেন লকডাউনের সময়ে।
২০২০ সালের জুলাই মাসে নাটোরের সিংড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করলে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সিংড়া উপজেলার চামারী ইউনিয়নের আনন্দনগর ও কৃষ্ণনগর গ্রামের ১০০ পরিবারের মাঝে ১০দিনের খাদ্য সহায়তা প্রদান করেন শেখ রিফাদ মাহমুদ। এছাড়াও উক্ত এলাকায় বিভিন্ন সময়ে সাবান, স্যানিটাইজার, মাস্ক ইত্যাদি বিতণ করেন এবং এ যাবতীয় কার্যক্রম বর্তমানেও পরিচালিত করছেন।
তাঁর কাজে সহায়ক শক্তি প্রদান করছেন তাঁর বাবা ও মা। পেশায় কলেজ অধ্যক্ষ বাবা ও শিক্ষিকা মা তাকে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে বিভিন্নভাবে সাহস ও উৎসাহ যোগাচ্ছেন, তারা বড় ভূমিকা পালন করছেন বলে শেখ রিফাদ মাহমুদ জানান। বিভিন্ন সময় ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যদিয়ে তাঁর সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী কাজে আসার আগ্রহ তৈরি হয়। নাটোর জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ক্যাবিনেটের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ রিফাদ মাহমুদ।
শেখ রিফাদ মাহমুদ জানান, ‘শতভাগ শিক্ষিত, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিংমুক্ত নিরাপদ একটি দেশ দেখতে চাই আমি। সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। জাতিসংঘের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার সামাজিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্যও কাজ করছি আমি। এতে আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই।’
শেখ রিফাদ মাহমুদ আরো জানান, ‘আমার সামাজিক কার্যক্রম আরো বড় পরিসরে পরিচালনার জন্য ‘বাংলাদেশ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। উক্ত ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আরো ব্যাপক আকারে কার্যক্রমগুলো সারাদেশে পরিচালনা করার ইচ্ছে আমার।’
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
সাপ্তাহিক অন্যধারা // আতারা