একটা সাইকেল কিনার খুব শখ ছিলো আমার। এইটা আমি চাইছিলাম আমার আব্বার কাছে। আব্বা কিনে দিতে পারে নাই। কারণ আমরা সাত ভাইবোন। চার বইনের বিয়া দিয়া আব্বার কাছে কষ্ট ছাড়া হয়তো আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। আমি সবার ছোট। তারপরও আব্বা আমার জন্য সাইকেল কিনতে পারে নাই।
সাইকেল নাই আমার-এই কষ্ট যায়না বুকের মাঝখান থাইক্কা। আমি প্রতিদিন দেখি সামছু কাকার সাইকেল, দেখি পাড়ার জাব্বার ভাইয়ের সাইকেল। সাইকেল আমার স্বপ্নের মতো হইয়া গেছিল। তখনো বাংলাদেশ হয় নাই। পূর্ব-পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। এই পূর্ব-পশ্চিম নিয়া অনেকদিন যাবত যুদ্ধের কথা শুনতাছি। যুদ্ধ শুরু হয় নাই তখনো।
আব্বা ঢাকায় চাকুরী করেন-ওয়াপদায়। ছোট চাকরী, সংসার চালাইতে কম যায়না। তাই হয়তো সাইকেলের টাকা হয়না।
পাড়ায় যে সামছু কাকার সাইকেল দেখি তা নিয়া কাকা সেই কুটির বাজারে যান প্রতিদিন কেনাকাটা করতে। তার মুদি দোকান আছে বাজারে, তাই ওই সাইকেল নিয়া তার সারাদিন ঘুরাফেরা। আর ওই যে জাব্বার ভাইয়ের কথা বললাম-সে প্রতিদিন স্কুলে যায় সাইকেলে চইড়া। আমারও তাই শখ হয় সাইকেলে কইরা স্কুলে যাই, গ্রামের কাঁচা পথে বিকাল হইলে ঘুরতে বাইর হই।
যুদ্ধ শুরু হইয়া যায়। বাংলাদেশ পাওনের জন্য যুদ্ধ। আমাদের আলাদা দেশ হইবো, ভাষা হইবো, শিক্ষা হইবো।
আমি যুদ্ধ বুঝি তাই ছোট কাকার ফিলিপস রেডিওতে প্রতি রাইতেই সবার সাথে উঠানে বইসা যুদ্ধের খবর-গান-নাটিকা শুনি। নিজের ভিতর চনমন করে-আমি যুদ্ধে যামু। রাজ্জাক মামা,খায়ের মামা, মানিক ভাই, উত্তর বাড়ির নেকবর, জব্বর, বিশ্বনাথ সবাই যুদ্ধে গেছে।
আমার কিশোর মন আমারে ডাকে,রক্তের ভেতর টান পড়ে। কিন্তু কেউ আমারে যুদ্ধে নেয় না। আমি নাকি খুব ছোড-আমার ভিতর ক্ষ্যাপা জিদ চাপে। একদিন রাগ কইরা আম্মারে বলি-আম্মা আমি যুদ্ধে যামু। আম্মা অবাক হইয়া ভয় ভরা চোখে আমার দিকে তাকায়-কস কি পুত। তুই গেলে আমি মইরা যামু। অমোন কথা কইছনা বাজান।
আব্বা ঢাকা থেকে ফিরা আসে না। আমি আব্বার জন্য অপেক্ষা করি। আমার মনের কথা আব্বা আমাদের গ্রামের মজিবুর কাকার কাছে জানতে পাইরা খবর দেয়-‘তুমি ছোট মানুষ যুদ্ধে যাওয়ার দরকার নাই। দেশের জন্য আমিতো কাজ করতাছি। আমরা ঢাকায় সব এক হইয়া মুত্তিবাহিনীর সাথে আছি।
আব্বার এই খবর পাইয়া আমার মন খুব বেজার হয়। কোন কাজে কিংবা পড়ালেখায় মন বসে না। পুকুর পাড়, খাল পাড়, আম গাছের ছায়ায় বইসা যুদ্ধের কথা ভাবি। আমার মনে যুদ্ধের বিমান, ট্যাংক, রাইফেল, কামান, গোলাবারুদ থাকে। মনে মনে আমি ঠিকই ফোঁসফাঁস করতে থাকি সারাদিন।
কদিন পরই হঠাৎ শুনি মুক্তিবাহিনীরা সামছু কাকারে মাইরা ফালাইছে। সামছু কাকা রাজাকার ছিলো। গ্রামের সব গোপন খবর পাকগো দিয়া আসতো। আর, আরো কী সব খারাপ কথা শুনছি। আমি মনে মনে বলি-ওইরকম কুত্তারে মারা ঠিক আছে।
তারও তিনদিন পর আলফাজ মেম্বার ছয়জন লোক নিয়া সন্ধার পর আমাদের বাড়িতে হাজির। এঁরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আমার মনের ভিতর আনন্দের শিহরণ বায়। পাড়ার অনেকেই আমাদের উঠানে ভিড় করছে। আম্মাকে ডাইকা মেম্বার কাকা বললেন-ভাবীসাব রাইতে খাওনের বন্দোবস্ত করেন। আজ এই পাড়ায় ডিউটি আছে।
আমি জানি ঘরে ভালো কিছু নাই তারপরও মনে হইলো তাগো ভালো কিছু খাওয়াতে হইবো। তারা যেমোন তেমোন লোক না-মুক্তিযোদ্ধা। তাই আম্মাকে না বইলা টাকা ধার কইরা আমি বাজার কইরা আনলাম-আম্মা এই নেন, খাওন রেডি করেন। আম্মা আমার বুদ্ধিতে খুব খুশি হন। মেম্বার কাকাও খুশিতে আমার প্রশংসা করলেন। আমাকে হাত বাড়াইয়া কাছে ডাকলেন। হাত ধইরা আমারে বুকের কাছে টাইনা বললেন-যুদ্ধ করবি ? ধর দেহি রাইফেলডা। হ -কাকা করমু। আমি আপনের মতো মুক্তি যোদ্ধা হমু। কিন্তু আব্বা আম্মা যাইতে দেয়না।
একটু চিন্তা কইরা মেম্বার কাকা আব্বার মতোই বললেন-তর আব্বা ঠিকই কইছে। তর যাওনের দরকার নাই। তয় তরে একটা কাম দিমু ওইডা করলেই তুই মুক্তি যোদ্ধা।
-কন কাকা আমি করমু। আপনেগো সব কথা শুনমু।
-তুই রাজাকারগো খবর দিবি। ওরা অনেক ক্ষতি করতাছে গ্রামে। অরাই গোপনে সব পাচার কইরা গ্রামডা আগুনে পোড়ানোর চেষ্টা করতাছে, তয় আমরা সতর্ক আছি। তুই লগে থাকলে আরো ভালো। আমার একটা সাইকেল আছে তরে দিমু। তুই আমাগো ওই সাইকেল দিয়া খোঁজ খবর জানাবি।
আমি এই খবরে নাচি, অনেক খুশি লাগে। মাথা নাড়িয়ে রাজী হইয়া বলি-আমি সব পারমু কাকা।
জীবনের সেই ক্ষণটা আমি ভুলতে পারি না। আমার মনে হইছিলো আজ আমি মুক্তিযোদ্ধা-আমার চারপাশে সবাই যোদ্ধা।
আলফাজ কাকার কথামতো আমি খোশঘর, ডালপা, জানঘরসহ অনেক পাড়ার যুদ্ধের গোপন খবর আনি আর সাইকেলে কইরা সব তাদের জানাইয়া দিয়া আসি। মাঝে মাঝে সাইকেলে কইরা খাবার দাবার দিয়া আসি। আমার পড়ালেখা বন্ধ। স্কুল বন্ধ।
স্কুল খোলা থাকলেও আমি যাইতাম না। বই আর আমারে টানে না।
আমারে কেবোল খেলার মাঠ ঈশারায় ডাকে। মাঠের পাশের আমগাছ জামগাছ আমাকে ফিসফিসিয়ে কি জানি কইতে চায়। গাছের পাতা ফল আমার দিকে চায়। জমির কঁচি মটরশুঁটি হাত বাড়ায়। তেতুলের ঝুলন্ত শলাকা আমার জিহ্বা কাছে লকলকে রস তৈরি করে। মাথায় সারাদিনের গরম রইদ নিয়া বাঁকা হইয়া আমি ব্যস্ত হই। গোপাটের পাড়ে ঝুলে পড়া লাল সাদা করমচার লবনাক্ত স্বাদ আমায় নাচায়-আলোড়িত করে। আমি লবন মরিচ মিলানো বরই খাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকি। আমার ডানপিটে স্বভাব আরো বাড়ে।
একদিন দেশ স্বাধীন হয়। আমি রাজ্জাক মামা খায়ের মামাদের সাথে পতাকা নিয়া সারা গায়ে দোড়াই। চিৎকার করি। সবাই আমাকে নিয়া উল্লাস করে। আনন্দের ঝিলিক সবার চোখে। বাজারে গেলে সবাই আমাকে রসগোল্লা কিনে খাওয়াইতে চায়।
কিন্তু অতো সুখের সংবাদ আসলেও আমার আব্বা ঢাকা থেকে আসে না।
বড় বুবু বাড়িতে আইসা আব্বার জন্য বাড়িতে মিলাদ পড়ান। আব্বা আসে না। আম্মা খালি কান্দেন আর কান্দেন। আম্মা পুকুর পাড়ে পাতিল মাজেন আর চোখের পানি ফেলেন, কলপাড়ে গিয়া খালি বিলাপ করে আব্বার জন্যে। আমি গোপাটের দিকে চাই আব্বা আসে না। কাঁচা সড়কের দিকে অনেক দূরে তাকাই প্রায় দিনই কিন্তু আমার আব্বার কোন খবর নাই। আমার আব্বাতো আসে না।
কয়দিন পর আর না পাইরা রাজ্জাক মামার সাথে লঞ্চে কইরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। আব্বার অফিসে আইসা শুনি মারাত্বক সেই সংবাদটি। এই সংবাদে আমার কলিজা ফাইটা যাইতে চায়। কি বলে আব্বার অফিসের লোকটা। আব্বার অফিসের আরো ছয়জন লোক আজো ফিরে নাই। তয় কি আব্বা …………..
আমি আর ভাবতে পারি না। লোকটির কথায় আমি কাঁইপা ওঠি, অজ্ঞান হইয়া পড়ি। মজিবুর কাকা আদমজী জুট মিলে চাকুরী করেন। তিনিও আব্বার কোন খবর জানেন না। শেষ পর্যন্ত মুজিবর কাকা আমাদের এই চরম বিপদে আগাইয়া আসেন। তার বুদ্ধিতে একমাস পর পূর্বের চকের আধ-কানি জমি বেইচা টাকা নিয়া আসি-দেই মুজিবুর কাকার হাতে। কাকা বড় ভালো মানুষ। তিনি আমাকে আম্মাকে নিয়া ঢাকায় আসেন।
পাড়ার সবাই আমাদের জন্য কান্দে। আবার সেই কান্না। গ্রামের পথঘাট কান্দে। কোরবানপুরের বাজারের শুকনো খালটি কাইন্দা কাইটা পানিতে ভইরা যায়। পুকুরের হাঁস কান্নায় শোকে বিরহে শব্দ তোলে। আমার দুইটা কবুতর ছিলো তারা আইজ উড়ে না, যায়না, ঘাড় বাঁকা করে বিরহে তাকায় । ডিগবাজী খায় না আকাশে। আমি ওদের সব কষ্ট বুঝি তবু ঢাকায় যাইতে হইবো। দেশে থাইকা লাভ নাই। ঢাকায় আমার আব্বা আছে। আমার মন বলে আব্বা অনেক দূরে যুদ্ধে গেছে তাই ফিরতে দেরি হইবো।
আব্বার টানেই আম্মাকে নিয়া সিদ্ধিরগঞ্জে চান মিয়ার বাড়িতে একরুমের বাসায় ওঠি। মুজিবর কাকার ঋণ শোধ করতে পারমু না কোনদিন। আমাকে একদিন ডাইকা বলে-ভাতিজা বইসা থাইকো না। তোমার ওই সাইকেলটা দিয়া স্কুলে স্কুলে চানাচুর লজেন বেঁচো। কলম বেঁচো। দুই টেকা না কামাইলে চলবা কেমনে মায়রে লইয়া। তোমার আব্বার আশায় বইসা থাকলে জীবন চলবোনা।
আমি সেই সাইকেলে চইড়া স্কুলে স্কুলে লজেন চানাচুর কলম বেঁচি।
সকাল নয়টায় বের হই আর দুইটা পর্যন্ত স্কুলে গেইটে বইসা থাকি। মাঝখানে একবার আম্মাকে দেখতে বাসায় যাই। স্কুুলে বাচ্চারা আমার সাইকেল দেখে ভিড় করে। সাইকেলের মইধ্যে সুন্দর করে সাজানো লজেন চানাচুরের পেকেট তাদের চোখে চিলিক ধরায়। ছুটির ঘন্টা বাজার সাথে সাথে তারা আমার সাইকেলের সামনে হুড়মুড় কইরা পড়ে। আমার বেঁচাবিকি অনেক ভালো হয়।
আমি খলিফার দোকানে গিয়া সাইকেলের কেরিয়ারে ক্রিং ক্রিং শব্দের বদলে ভেঁপুর সংযোজন করি। ওইটা বাচ্চারা খুব মন দিয়া শোনে। সাইকেলের দু‘পাশে রঙ্গিন কাপড় আর প্লাস্টিক মোড়ানো ব্যাগটাকে ওরা হাত দিয়ে ধরে-মজা পায়। আমি তখোন ওদের বলি-শোন এইটা কিন্তু যেমোন তেমোন সাইকেল না। যুদ্ধের সাইকেল। আমি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ করছি এই সাইকেল নিয়া। এই কথা বলার পরই আমার কান্না আসে। আমি চোখের পানি মুছতে গেলে কে যেনো বলে-আলী ভাই, তুমি কান্দ কেন। কান্দিনা আমার আব্বার কথা মনে হইছে।
আর আমি ভেজা চোখে সেই যুদ্ধের সময়কার সাইকেলের ভেঁপুটি জোরে আরো জোরে বাজিয়ে বাসার কাছে আসতে চাই আম্মার কাছে আসতে চাই। কিন্তু চোখ ঝাঁপসার কারণে আমার সাইকেলটি গলির এক বাঁকে স্কুটারের মুখে পড়ে। সাইকেলের সামনের ব্রেক, হ্যান্ডেল ভাঙ্গে। যুদ্ধের সময় পাক সেনাদের বোমার আঘাতে যেমোন মুকিমপুর ব্রিজটি ভাঙ্গে তেমনই আমার সাইকেলটিও আজ শেষ হইয়া যায়। এই সাইকেল ছিলো আমার যুদ্ধের বাহন, আম্মার সংসারের চালিকা শক্তি। ছিলো আব্বাকে খোঁজে পাওয়ার বাহন। কিন্তু আজ আর তা রইলো না।
আমার আব্বা নাই, সাইকেল নাই। আমার দুখিনী মা কেমোন আছে জানবার জন্য আমি তাড়াতাড়ি সব ফেলে বাসায় ঢুকি। বাসায় আইসা দেখি আম্মা কান্দে।
আমার চোখে আব্বার ছবি ভাসে, আমি কাঁন্দি, আমার অনেক কান্না পায়-আরো কাঁন্দি। জোরে জোরে কাঁন্দি।