সাপ্তাহিক অন্যধারা-এর পক্ষ থেকে কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক রতনতনু ঘোষের মুখোমুখি হয়েছেন সাব্বির আলম চৌধুরী।
প্রশ্নঃ সাম্প্রতিক বাংলাদেশ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
উত্তরঃ বাংলাদেশ এগিয়েছে, আরো এগিয়ে যাবে। এ অগ্রগতি রাজনৈতিক অস্থিতি, জ¦ালাও-পোড়াও, ভাংগন, হুমকি, হত্যা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে। কালো ভাবমূর্তি অনেকটা কমেছে। তবুও রয়ে গেছে হুমকি, হত্যা, দখল ও নির্যাতন। বিশেষত উগ্রবাদি হামলা, গুপ্তহত্যা, আতংকের পরিবেশ, সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও দেশত্যাগ থামছে না সহজে। সরকারী ও বিরোধী দল পারস্পরিক দোষারোপ করছে। জনগণ ভাবছে, দায় সরকারের। অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দিতে পারলে ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে, জনগণ আশার আলো দেখবে।
প্রশ্নঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, কয়েক জনের ফাঁসি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপানার বিশ্লেষণ কী ?
উত্তরঃ হ্যা, ইতিহাসের নিয়ম অনুযায়ী সাংবিধানিকভাবে তা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এতে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গিকার রক্ষা হয়েছে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়েছে। নানা চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার তা করেছে। এখন এ বিচারের প্রতি সৌদি আরবসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়েছে।
প্রশ্নঃ পাকিস্তান ও তুরষ্কের ঔদ্ধত্যকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
উত্তরঃ পাকিস্তান বরাবর আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী। আবারও প্রমাণ হলো পাকিস্তান একটি অপশক্তির নাম। যদিও সে দেশের লেখক বুদ্ধিজীবীগণ এবং বিবেকবান জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তবু পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক সংকুচিত করা যেতে পারে।
প্রশ্নঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান সরকার স্বীকার করলেও অনেকে তাকে দালালি বলে মনে করেন। কেন?
উত্তরঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাকে ভারতের দালাল মনে করলে কিছু করার নেই। আমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে যাবো। আওয়ামী লীগ ভারতের কাছ থেকে অনেক কিছু এনেছে। ঘনিষ্ঠতা ও সুসম্পর্ক আরো বাড়বে।
প্রশ্নঃ ভারত বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশের জনগণকে ভিসা নিয়ে ভারতে ঢুকতে হয়। উপরন্তু কাঁটাতারের বেড়া থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত সীল করে দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে। এটা কেনো?
উত্তরঃ চোরাচালানি, মানবপাচার, নাশকতা ও অনিরাপত্তার কথা ভেবে সীমান্তে বারবার কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে, বিশ^ায়নের যুগে এবং ভারত-বাংলাদেশ ঐতিহাসিক সুসম্পর্কের কারণে ভিসা প্রথার কড়াকড়ি ও কাঁটাতারের বেড়া দুদেশের জনগণের জন্য অবমাননাকর। প্রতি মাসে বাংলাদেশ হতে নয় লক্ষাধিক লোক যাতায়াত করে ভারতে। এর সংখ্যা আরো বাড়বে। এখন বাসে, ট্রেনে ও বিমানে টিকেট পাওয়া কষ্টকর। উভয় সরকারকে বিষয়টির প্রতি জরুরী গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রশ্নঃ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়া ও সংবাদপত্রের জন্য কতোটুকু হুমকির কারণ?
উত্তরঃ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়া ও সংবাদপত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে হলেও এতোদিনে প্রমাণ হয়েছে দুটি স্বতন্ত্র ধারা। বর্তমানে নামকরা দৈনিক পত্রিকাগুলোর ই-ভার্সন প্রকাশিত হয়। অনলাইন পাঠক বিশ^ব্যাপী প্রসারিত। মুদ্রিত পত্রিকা ও বই সর্বত্র পৌঁছেনা। সহজে ও দ্রুত পাঠ করার জন্য এবং সর্বশেষ সাম্প্রতিক খবর জানার জন্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া কিংবা অনলাইন পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাঠকদের চাহিদা বিবেচনা করেই মুদ্রিত সংবাদপত্র ও বইয়ের প্রকাশকগণ অনলাইন ভার্সন করেন।
প্রশ্নঃ অনলাইন পত্রিকায় গুজব ও অপপ্রচার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
উত্তরঃ হ্যাঁ। যে কোনো ধরনের গুজব ও অপপ্রচার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে এসব অপপ্রচার ও গুজবের বিরোধিতা করে যেসব বক্তব্য ও প্রামাণ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সেগুলো অপপ্রচার ও গুজবের সমাপ্তি ঘটায়। অনলাইনের গতিবেগ নিয়ে শঙ্কা না করে বরং দায়িত্বশীল মত ও সংবাদ প্রচার করা প্রয়োজন। সেটি অনলাইন পত্রিকার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মুদ্রিত পত্রিকার জন্যও জরুরী। অনলাইন নীতিমালা মেনে চলা এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
প্রশ্নঃ অনলাইন মিডিয়া চিন্তা ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কতটুকু নির্ভরযোগ্য?
উত্তরঃ অনলাইন মিডিয়া নতুন চিন্তা ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে অবশ্যই নির্ভরযোগ্য। এ ক্ষেত্রে দায়দ্ধতা থাকবে অবশ্যই। ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে বিদ্বেষ কিংবা অবমাননা কেবল অপপ্রচার ঘটায়, যাহা পরিণতিতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, সন্ত্রাসী গোষ্ঠি কিংবা অপরাধের দুষ্টচক্র এ পথে সুযোগ খুঁজে থাকে। লেখক ও প্রকাশককে এ ব্যপারে সতর্ক হয়ে মত প্রকাশ করতে হবে।
প্রশ্নঃ আপনি অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত হলেন?
উত্তরঃ আমি অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি যেদিন থেকে বাংলাদেশের প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলোর ই-ভার্সন চালু হলো। মনে পড়ে, মুদ্রিত পত্রিকার হারিয়ে যাওয়া কপির সন্ধানে গুল-এ গিয়ে সংবাদপত্র অনুযায়ী এবং লেখক ও লেখার শিরোনাম ভিত্তিক অনুসন্ধান করেছিলাম। তাতে উপকৃত হয়েছি। এমনকি পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখা যেসব অনলাইন পত্রিকা ছেপেছে সেগুলোর লিংক পেলাম। এভাবে আমারে লেখা প্রকাশ ও সংরক্ষণের বাহন হয়েছে অনলাইন মিডিয়া।
প্রশ্নঃ আপনি কি গুগলে ই-বুক সন্ধান করেছেন? আপনার ই-বুকগুলোর প্রতি পাঠকদের সাড়া কীরূপ?
উত্তরঃ গুগলে অনুসন্ধান করে আমার আটটি বইয়ের ই-সংস্করণ পেয়েছি। মাওলা ব্রাদার্স প্রথম এক যুগ আগে আমার অনুদিত ও সম্পাদিত বই ‘উত্তরাধুনিক চিন্তাধারা : দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ’ পৃথিবীর বৃহত্তম অনলাইন লাইব্রেরী আমাজনে দিয়েছে। প্রথমে এটি পাঠকদের জন্য ফ্রি দিলেও এখন সেটি ওপেন করতে ডলার ধার্য করা হয়। আমার ই-বুকগুলোর প্রতি পাঠকদের সাড়া বেশ। আমার লিখিত অঙ্কুর প্রকাশনীর বই ‘অগ্রসর বাংলাদেশ ও কথা চিরন্তন’ ইবুক হিসেবে পাওয়া যায়। এছাড়া উল্লেখযোগ্য হলো অবসর প্রকাশনা সংস্থার ‘বিশ^বিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা’ এবং বিভাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আমার ‘কাব্য কলাম’ বইটি। আরো অনেক বই ইতোমধ্যে ই-বুক হিসেবে পাঠকদের নিকট গৃহীত হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত আমার হাজারো লেখার ই-ভার্সন পাওয়া যায়। এভাবে নিজের লেখার সঙ্গে ই-বুক পাঠকদের সম্পৃক্ততা অনুভব করি।
প্রশ্নঃ ই-বুক প্রকাশনা শিল্পের জন্য সহায়ক না বাধা?
উত্তরঃ ই-বুক প্রকাশনা শিল্পের জন্য মোটেও বাধা নয়। মুদ্রিত বইয়ের ফটোকপি ও পাইরেসি আটকে রাখা যাচ্ছে না। অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে ই-বুক ডাউনলোড করে বিশে^র যেকোন পাঠক উপকৃত হতে পারে। এছাড়া ফ্রি বইগুলোর চাহিদাও কম নয়। প্রকাশিত বই পাঠকের জন্য নিবেদিত। বইয়ের নকল ধরা পড়লে তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ এবং পাইরেসি এ্যাক্ট প্রয়োগ করা জরুরি।
প্রশ্নঃ ডিজিটাল লেখার স্থায়ীত্ব ও গুরুত্ব নিয়ে ভেবেছেন কখনো?
উত্তরঃ ডিজিটাল লেখার স্থায়ীত্ব ও গুরুত্ব নিয়ে ভেবেছি ইতিবাচক ভাবে। যতদিন অনলাইন ব্যবস্থা চালু থাকবে, ততোদিন হারাবে না লেখা ও ইমেজ। তবে ই-লাইব্রেরীর পাশাপাশি পাঠকদের জন্য গ্রন্থাগারতো আছেই। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত বইয়ের হার্ড কপির উপযোগিতা চিরকালীন।
প্রশ্নঃ অনলাইন এক্টিভিস্ট ও লেখকদের উপর হুমকি কেনো?
উত্তরঃ যখন অনলাইনে লেখালেখি হতো না তখনও মুক্তমত ও স্বাধীন চিন্তার বিরোধী পক্ষ ছিলো। এখন অনলাইন এক্টিভিস্ট ও লেখকদের প্রকাশিত রচনা সহজে যে কেউ পাঠ করে লেখকসত্তা কিংবা লেখকের চিন্তাধারা ও মতাদর্শ জানতে পারে। তবে, মতকে ভিন্নমত দিয়েই প্রতিহত করা উত্তম। লেখকের উপর সশস্ত্র আঘাত কাম্য নয়। আইনের উর্দ্ধে কেউ নয়। আইন হাতে তুলে নিয়ে অপরাধ করা কাম্য নয়।
প্রশ্নঃ চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে থাকলে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনামূলক চিন্তা প্রসারিত হতে পারবে কি?
উত্তরঃ চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে থাকলে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনামূলক চিন্তা প্রসারিত হতে পারবে না। এটি নতুন কথা নয়। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সর্বজনীন মানবাধিকার। এটি জাতিসংঘ সংবিধানে যেমন গৃহীত তেমনি তা রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও সংরক্ষিত। তবে, কারো ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাত কাম্য নয়।
প্রশ্নঃ লেখালেখির বিশ্বায়নে অনলাইন মিডিয়া কতটুকু কার্যকর হচ্ছে?
উত্তরঃ লেখালেখির বিশ্বায়নে অনলাইন মিডিয়া প্রধান সহায়ক। দেশের লেখা বিদেশে পৌঁছে যায়। বিশে^র সেরা লেখকদের লেখা অনুবাদ মাধ্যমে দেশের সাহিত্য পরিসর বৃদ্ধি করা যায়। দেশের লেখকের সঙ্গে বৈশি^ক পাঠকের পরিচিতি ও যোগসূত্র গড়ে ওঠে। অনলাইন মিডিয়ার অতিপ্রসার ও প্রচারণা লেখালেখির বিশ্বায়নে অবাধ বাতায়ন তৈরি করে। লেখক ও পাঠক উভয়েই উপকৃত হন। লেখালেখির মাধ্যমে চিন্তার বিশ^ায়ন ঘটছে দ্রুত।
প্রশ্নঃ বাংলাদেশে অনলাইন মিডিয়ার অবাধ প্রবাহ কতোটুকু অগ্রসর?
উত্তরঃ বাংলাদেশে অনলাইন মিডিয়ার অবাধ প্রবাহ রয়েছে। মিডিয়া বিষয়ক একটি বৈশি^ক গবেষণা প্রতিবেদনে এ সত্য প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে অবাধে যে কেউ অনলাইন মিডিয়ার সম্পাদক ও মালিক হচ্ছেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। অনলাইন নীতিমালা মেনে চলার তাগিদও রয়েছে। সহস্রাধিক অনলাইন পত্রিকার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় অনলাইনে প্রবেশ করলে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের স্বাধীনতা এবং লেখক ও প্রকাশকের স্বাধীনতা-আনুকুল্য অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
প্রশ্নঃ আপনার লেখালেখি সম্পর্কে অন্যধারার পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
উত্তরঃ ‘সাপ্তাহিক অন্যধারা’ একটি সাহিত্যনির্ভর সৃজনশীল সাময়িকী। এর পাঠক সংখ্যাও কম নয়। এ পত্রিকার সম্পাদক-পাঠকসহ অন্যধারা পরিবারের সকলকে পরিশুদ্ধ লেখার বাগানে প্রবেশের জন্য অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।