সাহিত্যস্রষ্টার মেধাস্বত্ব চেতনা : প্রসঙ্গ বাংলাদেশ ।। মুহম্মদ নূরুল হুদা

%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b9%e0%a6%ae%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%a6-%e0%a6%a8%e0%a7%82%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a7%81%e0%a6%a6%e0%a6%be১.
বাংলাদেশে ‘কপিরাইট’ ধারণাটি নতুন না হলেও এর অর্থ এখনো সকলের কাছে স্বচ্ছ বলে মনে হয় না। যারা এর সঙ্গে কর্মসূত্রে জড়িত নন তাদের জানাটা ভাসা-ভাসা তো হতেই পারে, কিন্তু যারা পেশা ও নেশাসূত্রে এই অভিধানটির সঙ্গে সর্বক্ষণ প্রতিক্রিয়াপ্রবণ, তারাও এর কার্যকারিতা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন নন। এই যখন অবস্থা, তখন ২০০৮ সাল থেকে হঠাৎ করে বহিরাগত চাপের ফলে বিষয়টি নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হয়। বিশেষত সঙ্গীত, সাহিত্য ও সফট ওয়ারের পাইরেসি ঠেকানোর জন্যে কয়েকটি ধনী ও উন্নত দেশের চাপে এবং ওয়াইপো-ডব্লিউ.টি.ও-র প্রণোদনায় কপিরাইট ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রপার্টি রাইট নিয়ে বাংলাদেশে বেশ কিছু সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হতে থাকে। কোনো কোনো শীর্ষ ধনী দেশ এমন হুমকিও দেয় যে, বাংলাদেশে তাদের রফতানিকৃত মূর্ত বা বিমূর্ত শিল্পপণ্যের (কালচারাল গুডস) পাইরেসি ঠেকানো না হলে তাদের প্রদেয় বাৎসরিক আর্থিক সাহায্য, ঋণ, অনুদান ইত্যাদি বন্ধ করা হতে পারে। ফলে, বাংলাদেশের কপিরাইট অফিস ও পেটেন্ট-ডিজাইন-ট্রেডমার্ক অফিসও গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। এমনকি পাইরেসি বা তাস্কর্য রোধে টাস্কফোর্স গঠন এবং সেই টাস্ক ফোর্সের আকস্মিক অভিযান শুরুর মতো চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটতে থাকে। ২০০০ সালে বাংলা ভাষ্যে যে কপিরাইট আইন প্রবর্তিত হয়েছিল, ২০০৫ সালে তাতে নতুন কিছু সংশোধনী যুক্ত হলো। উদ্ভূত ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যে আরো কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংশোধনী প্রস্তাবিত হলো। এই প্রস্তাবগুলো গত বছর আটেক ধরে অনুমোদন জটিলতার চাকায় ঘূর্ণায়মান আছে, কিন্তু কোনো ফলোদয় হয়নি। এ-কারণে অবস্থারও তেমন দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়নি।

তা সত্বেও নেশা ও পেশাসূত্রে যারা জড়িত, তাদের মধ্যে যারা পাইরেসির ফলে ক্রমাগত সম্পদহানির শিকার হয়েছেন, তাদের বৈষয়িক দৌড়ঝাপের ফলে মেধাস্বত্ব বিষয়ক সচেতনতা ও প্রয়োগে কিছু বাস্তব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। যেমন, সংগীতের ক্ষেত্রে স্বত্বাধিকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে সংগীত প্রণেতাদের সমন্বয়ে অন্তত একটি ‘কপিরাইট  সমিতি’ গঠিত হয়েছে এবং নতুন নতুন সঙ্গীতকর্মের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে বাস্তবভিত্তিক চুক্তি সম্পাদিত বা নবায়িত হচ্ছে। পুরনো অনেক বিষয়ে মামলা ইত্যাদি শুরু হয়েছে এবং কোনো মামলার রায়ও হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো, সংগীত তার বৈষয়িক সাফল্যের কারণেই প্রণেতাদের কাছে উত্তরোত্তর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

কিন্তু মেধাস্বত্বের অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষত সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের এই বাংলাদেশে বিষয়টি এখনো পূর্ববৎ থিতু অবস্থায় রয়ে গেছে। অথচ ১৮৮৬ সালে বার্ন কনভেশন প্রবর্তিত হবার পর থেকে এ-পর্যন্ত ১৩০ বছর ধরে ‘সাহিত্য’ই মেধাস্বত্বের প্রধান এলাকা বলে ভাবা হয়েছে। এ সম্পর্কে লেখক-সাহিত্যিক-প্রকাশকদের সচেতনতাই সর্বপ্রথম কামনা করা হয়েছে। পশ্চিমা দেশ, এমনকি আমাদের প্রাচ্যের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও লেখক-সাহিত্যিক-প্রকাশকদের মধ্যে এই সচেতনতা আনুপাতিকাহারে যথেষ্ট প্রখর, কিন্তু বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত তা প্রার্থিত স্তরে পৌঁছেনি। এর দায়িত্ব সমবেতভাবে সকলের ওপর বর্তালেও মূল দায়টা বোধ করি স্বয়ং লেখক-সাহিত্যিক তথা সাহিত্যস্রষ্টাদেরই। ২০১০ সালের দিকেই আমরা লেখকদের জন্যে একটি কপিরাইট সোসাইট প্রস্তাব করেছিলাম (বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি), কিন্তু প্রাথমিক দৌড়ঝাপের পর মূলত লেখকদের অনীহার কারণেই এই পদক্ষেপটি স্তিমিত হয়ে আছে।

সাহিত্য যে নেশার পাশাপাশি একটা অর্থকরী পেশা হতে পারে, এটা দু-একজন ভাগ্যবান কবি-সাহিত্যিক ছাড়া অন্যরা ভাবতেই পারেননি। অন্য একটি পেশার পাশে সাহিত্যচর্চা তাদের কাছে একটি সৌখিন নান্দনিকতা বিশেষ, যা অর্থমূল্যহীন, কিন্তু সমাজে কদর বাড়াতে সক্ষম। ফলে, তাদের সাহিত্যচর্চায় পেশাদারিত্ব সূচিত হয়নি। একটি কবিতা বা গল্প বা উপন্যাস লিখে তারা তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। তারপর তা প্রকাশককে বিনাশর্তে বিনাচুক্তিতে প্রকাশ করতে দিয়ে নিজেই ধন্য হন। অধিকাংশ প্রকাশকও এই সুযোগ নিয়ে খুশি। ব্যতিক্রম শুধু সেই সব লেখক, যাদের কাছে নানাবিধ প্রতাপের কারণে প্রকাশকরা দায়বদ্ধ। বিদেশবাসী, দেশী ধনী থেকে শুরু করে প্রতাপশালী আমলারা এই গোত্রভুক্ত। ফলে না রচনায়, না প্রকাশনায় পেশাদারিত্ব সূচিত বা বিকশিত হচ্ছে। প্রকাশকরা গুটিকয়েক জনপ্রিয় লেখক, বিদেশি চালু বইয়ের অনুমোদিত-বা-অননুমোদিত সংস্করণ/ মুদ্রণ কিংবা বিভিন্ন পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকের সহায়ক চালু গ্রন্থাদি ছেপেই তুষ্ট ও লাভবান। সৃজনশীল প্রকাশকদের অনেকেই বইয়ের জন্যে ব্যাংকঋণ নিয়ে কিছু বই ছেপে বাকিটা অধিকতর লাভজনক কোনো ব্যবসায় লগ্নী করতে তৎপর। ফলে সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশক থাকলেও পেশাদারিত্ব নেই। এর মূল কারণ প্রকাশক নয়, লেখক, যিনি তার সৃষ্টিসত্তার নানামাত্রিক মূল্য সম্পর্কে অসচেতন। নিজের সৃষ্টির রচনাগত, নীতিগত, সংহতিগত, নন্দনগত ও বাণিজ্যগত মালিকানা যে তার, এই বোধ আমাদের প্রায় ৯০% সাহিত্যস্রষ্টার বোধগম্য নয়। তার সৃষ্টিশীল রচনাটি যে সৃষ্টিপণ্য বা শিল্পপণ্য বা নন্দনপণ্য হতে পারে, তা তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাবতে পারেন কিনা সন্দেহ। ফলে একটি সমাজে মেধাস্বত্ব বিষয়ক ধারণার জন্যে যে প্রাথমিক সচেতনতা প্রয়োজন, তা আমাদের স্বাক্ষর সমাজেও প্রায় অনুপস্থিত। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে আমাদের সমাজে জ্ঞানের নবায়ন যেমন হবে না, তেমনি অর্থকরী সফলতাও বিঘ্নিত হবে।

আরো একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। সাহিত্যস্রষ্টাদের ক্ষেত্রে তাদের সৃষ্টকর্মের মালিকানা, তাদের নৈতিক ও আর্থিক পরিপ্রেক্ষিতটাই প্রথম বিবেচনা নয়, বরং মুখ্য বিবেচনা হচ্ছে রচনাটি মৌলিকতার বিচারে তার সৃষ্টি কিনা। একজন লেখক অন্যের রচনা সচেতন বা অচেতনভাবে অনুকরণ করেই এই পাইরেসি তাস্কর্য করতে পারেন। অনুবাদ বা অনুসরণের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো ভয়ঙ্কর। পাবলিক ডোমেন বা মেধাস্বত্বহীন সৃষ্টি নিয়ে কোনো তর্ক নেই। কিন্তু মেধাস্বত্বাধীন রচনার ক্ষেত্রে মূল লেখকের বা প্রকাশকের বা মেধাস্বত্বের অধিকারীর অনুমতি ছাড়া অনুবাদ গোঁড়াতেই পাইরেসির নামান্তর। বাংলাদেশে এই তাস্কর্য চলছে অবিরাম। এই দায় মূলত সংশ্লিষ্ট লেখক বা অনুবাদক বা অভিযোজনকারী বা অন্যরূপ সাহিত্যস্রষ্টার।

২.
জমি বা হীরের মুকুট যেমন একটি সম্পদ, তেমনি নিজের বোধ-বুদ্ধি-কল্পনা-মেধাও সমান মূল্যবান সম্পদ। এই চেতনাই একজন মৌলিক ও সদাচারী সাহিত্যস্রষ্টার মেধাস্বত্ব বিষয়ক আসল সচেতনতা। প্রথমটি বিচ্ছেদ্য হলেও দ্বিতীয়টি শতভাগ অচ্ছেদ্য। জমি বা হীরের মুকুট অন্যকে প্রদান করা যায় বা বিক্রি করা যায়, কিন্তু নিজের সৃষ্টিশীলতা নিকটতম পুত্রকন্যাকেও হস্তান্তর করা যায় না। এই বোধ একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে সহজে সঞ্চারিত হওয়ার কথা নয়। জাপান ও অন্যান্য উন্নত দেশের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে শৈশবের পাঠ্য পুস্তকেই এই সত্যটি নীতিবাক্য হিসেবে চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে। আমাদের মেধাবী শিশুসাহিত্যিকরা এই নিয়ে গল্প-কবিতা-ছড়া লিখতে পারেন। তবে তার আগে তাকে কপিরাইট আইনের পাঠ নিতে হবে। কপিরাইট আইন নিজের নিত্যনৈমিত্তিক পাঠ্যবস্তু হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আর এর সুযোগ করে দিতে হবে কপিরাইট অফিস বা বাংলা একাডেমি বা লেখক সংগঠন বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বা অনুরূপ কোনো উপযুক্ত সংস্থাকে। সারা বৎসর পর্যায়ক্রমে কপিরাইট বিষয়ক সেমিনার বা আলোচনা-চক্র চালু রাখতে হবে সকল বয়সী লেখকদের মধ্যে। এই বোধ সঞ্চারিত করতে হবে যে মেধাস্বত্বহীন সৃষ্টি যেমন বৈধ সৃষ্টি নয়, তেমনি মেধাস্বত্ববোধহীন রচয়িতাও বৈধস্রষ্টা নয়। এই বোধ লেখককে মর্যাদান, আত্মসম্মানসম্পন্ন ও স্বাবলম্বী করে তুলবে। লেখক তখন নিজের মৌলিক সৃষ্টিকে নান্দনিক সৃষ্টি থেকে শুরু করে ব্যবসাসফল পণ্য হিসেবেও বিবেচনা করতে শিখবেন।

তখন সংশ্লিষ্ট লেখকের লেখায় পেশাদারিত্ব আসবে।

এক একুশে মেলায় তখন কিছুতেই তিন-চার হাজার অমৌলিক ও অসম্পাদিত বই বেরোবে না, যার কোনো জ্ঞানমূল্য বা বিক্রিমূল্য নেই। যার কোনো পেশাদার প্রকাশক নেই। নেই পেশাদার ক্রেতাও। নগণ্যসংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া নিজের বই অসম্পাদিত অবস্থায় নিজেই প্রকাশের রীতি বন্ধ করতে হবে। প্রকাশক যখন বই বের করবেন তখন মেধাস্বত্বের ধারা অনুসরণ করে লিখিত চুক্তি মোতাবেক গ্রন্থটি প্রকাশ করবেন। এই বিষয়াবলি নিশ্চিত করার জন্যে মেধাস্বত্ব সম্পর্কে সচেতন সাহিত্যস্রষ্টারা মিলে যথাশীঘ্র কপিরাইট সোসাইট গঠন করবেন। প্রকাশকদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এই বিষয়ে সহযোগিতা দিতে পারে। চুক্তির শর্তাবলী সংশ্লিষ্ট লেখক ও প্রকাশক স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করবেন, তবে তা কপিরাইট আইনের পরিপন্থী হবে না।
গ্রন্থ রচনা, প্রকাশনা ও বিপণনের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্বের এই প্রক্রিয়া অনুসৃত হলে একুশে বইমেলা বা অন্য যে কোনো সময়ে যে কোনো লেখকের যে কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হলে তা গ্রাহ্য সৃষ্টি হিসেবে বৈধতা পাবে। ফলে, এ ধরনের প্রতিটি গ্রন্থ প্রাতিষ্ঠিক ক্রয়ের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ক্রয়ের ক্ষেত্রেও প্রণোদনা পাবে। বাংলাদেশের প্রকাশনার জগতে পেশাদারিত্ব নতুন যুগে প্রকাশ করবে।

৩.
তাত্ত্বিকভাবে দেশে-বিদেশে মেধাস্বত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে তিনিটি পর্যায়কেই মুখ্য মনে করা হয়: ১. যথাযথ আইন ২. যথাযথ আইনী প্রতিষ্ঠান ও ৩. আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আমাদের দেশে তিনটিই আছে, কিন্তু ‘যথাযথ’ কিনা বিবেচ্য। আইন তখনি যথাযথ হয়, যখন তা সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত ও সময়ানুগ হয়। প্রতিষ্ঠান বা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই সব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নতি ঘটবে নি:সন্দেহে। কিন্তু যা সর্বাধিক প্রয়োজন তা হলো আমাদের সাহিত্যস্রষ্টা, প্রকাশক, বিক্রেতা, ক্রেতা ও পাঠকপাঠিকার মধ্যে মেধাস্বত্ব সম্পর্কে সহজ সরল বোধগম্য ধারণা ও সচেতনতা। আমরা তিনটি পর্যায়ের পূর্ব-স্তরে অর্থাৎ এই প্রারম্ভিক সচেতনতার মধ্যেই আছি। তাই বলবো, মেধাস্বত্ববান জাতি মানে সমাজের সব মানুষের মাঝে মেধাস্বত্বের সহজপাঠের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্তার। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বমানুষ যদি মেধাস্বত্ব নিয়ে সৃষ্টিশীল হতে থাকে, আমরা কি পিছিয়ে পড়বো? শিশুর সারল্য নিয়ে বলবো, না; আমরাও এগিয়ে যাবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here