ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) সংস্কৃত পন্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, জনহিতৈষী। তিনি ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া প্রতি বছরই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ ও আর্থিক পুরস্কার পান।
সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজপাঠ্য করে তোলেন।
বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। বিধবা বিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তার অক্লান্ত সংগ্রাম আজও স্মরিত হয় যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে তার স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী কলকাতার আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিদ্যাসাগর সেতু তারই নামে উৎসর্গিত।
তাই শিশুদের জন্য আধুনিক জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রচনা করলেন বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী, আখ্যানমঞ্জরী, বোধোদয় ইত্যাদি গ্রন্থ। পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সীতার বনবাস, শকুন্তলা প্রভৃতি। সংস্কৃত ব্যাকরণ উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ কৌমুদী লিখে সংস্কৃত শিক্ষার্থীদের এবং সংস্কৃত পণ্ডিতদের রক্ষণশীল শিক্ষাপদ্ধতি থেকে মুক্তি দিলেন, সরল করলেন সংস্কৃত পাঠ।
শিক্ষা বিভাগের পরিদর্শক হিসাবে চাকরি করার সময় বিদ্যাসাগর বাংলার দুর্গম অঞ্চলে শিক্ষার দুরবস্থা সরকারের নজরে আনেন। কখনও বা সরকারের সহযোগিতায় অথবা কখনও বা একক প্রচেষ্টায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সময়কালে সংস্কৃত কলেজ ছিল সংস্কৃত শিক্ষার রক্ষণশীল কেন্দ্র। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা পদ্ধতি সংস্কার সাধন করে তাকে মানবতা নার্সারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রূপে গড়তে চেয়েছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠকুর বলেছেন, “তাঁর প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা। যদি এই ভাষা কখনো সাহিত্য সম্পদে ঐশ্বর্যশালিনী হইয়া উঠে, যদি এই ভাষা অক্ষর ভাবজননী রূপে মানবসভ্যতার ধাত্রীগণের ও মাতৃগণের মধ্যে গণ্য হয়, যদি এই ভাষা পৃথিবীর শোক-দুঃখের মধ্যে এক নতূন সান্তনাস্থল, সংসারের তুচ্ছতা ও ক্ষুদ্র স্বার্থের মধ্যে এক মহত্ত্বের আদর্শলোক, দৈনন্দিন মানবজীবনের অবসাদ ও অস্বাস্থ্যের মধ্যে এক নিভৃত নিকুঞ্জবন রচনা করিতে পারে, তবেই তাঁহার এই কীর্তি তাঁহার উপযুক্ত গৌরব লাভ করিতে পারিবে। বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যর্থার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্য সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপূণ্যের অবতারণা করেন।”
ভাষা যে শুধুমাত্র ভাব আদান প্রদানের একটি মাধ্যম নয় তার দ্বারা যে আরো বেশি কিছু করা সম্ভব তা বিদ্যাসগরই প্রথম দেখিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকর্ম ভালভাবে পর্যবেক্ষন করলে বোঝা যাবে বক্তব্যকে সরল, সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে কিভাবে সাহিত্যের প্রকৃত স্বার্থকতা সৃষ্টি করতে হয় তা তিনি করে দেখিয়েছেন। “বেতালপঞ্চবিংশতি” বিদ্যাসাগর রচিত প্রথম বাংলা বই। তবে এটি মৌলিক রচনা নয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেক্রেটারী মর্শাল সাহেবের অনুরোধে বিদ্যাগর “বৈতাল পচীসী” নামক একটি হিন্দী বই-এর অনুবাদ করেন। বাংলা সাহিত্যে তখনও বঙ্কিমচন্দ্রের আর্বিভাব হয়নি। উপন্যাস ও গল্পের স্বাদ তখনো বাঙালী জাতি পয়নি। তাই “বেতালপঞ্চবিংশতি” শুধু ভাষার জন্য না গল্পের জন্যেও সমাদৃত। যদিও “বেতালপঞ্চবিংশতি” হিন্দী থেকে অনুবাদ করা কিন্তু বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ তার নিজস্বতা বজায় রেখে অনন্য দক্ষতার সাথে যা উপস্থাপন করেছেন। “বেতালপঞ্চবিংশতি” থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। “তথায় এক অতি মনোহর সরোবর ছিল। তিনি তাহার তীরে গিয়া দেখিলেন, কমল সকল প্রফুল্ল হইয়া আছে; মধুকরেরা মধুপানে মত্ত হইয়া গুণ গুণ রবে গান করতেছে; হংস, সারস, চক্রবাক প্রভৃতি জলবিহঙ্গগণ তীরে ও নীরে বিহার করিতেছে; চারিদিকে, কিশলয় ও কুসুমে সুশোভিত নানাবিধ পাদসমূহ বসন্তলক্মীর সৌভাগ্য বিস্তার করিতেছে; সর্বতঃ শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের মন্দ মন্দ সঞ্চার হইতেছে।”
মার্শম্যানের Outlines of the History of Bengal for the Use of Youths in India কে অনুবাদ করে বিদ্যাসাগর লেখেন “বাংলার ইতিহাস”। বইটিতে নবাব সিরাজদৌলার রাজত্বলাভের পর থেকে লর্ড বেন্টিং এর সময় পর্যন্ত ইতিহাস লিখিত হয়েছে। জানা যায় সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের ইতিহাস লেখার ইচ্ছা ছিল বিদ্যসাগরের কিন্তু শারীরিক অসুস্থ্যতার জন্য তা আর সম্পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। বিদ্যাসগর মূলত সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অসাধারণ পন্ডিত ছিলেন। মহাকবি কালিদাসের অমর কাব্যগ্রন্থগুলি অনুবাদ করে বাংলাসাহিত্যর ভিত রচনা করেন তিনি। কালিদাসের “রঘুবংশ”, “কুমারসম্ভব” এবং মেঘদূত সম্পাদনার পাশাপাশি “শকুন্তলা”র অনুবাদও করেন তিনি। তৎকালীন সময়ে “শকুন্তুলা”র জনপ্রিয়তা থেকে আন্দাজ করা যায় তার অবদান। সংস্কৃত ভাষা’র এই পন্ডিত ইংরেজি ভাষায়ও সমান দক্ষ ছিলেন। শেক্সপীয়রের “The comedy of Errors” এর অনুবাদ “ভ্রান্তিবিলাস” রচনার মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগরের হাস্যরস প্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর যে শুধু মনোরঞ্জনের জন্য সাহিত্যচর্চা করেছিলেন তা নয়। বাল্যবিবাহ রোধ এবং বিধবা বিবাহের প্রচলনের জন্য তার কলম ছিল সক্রিয়। “বাল্যবিবাহের দোষ” নামে একটি প্রবন্ধ সেই সময় কঠোর সমাজ ব্যবস্থাকেও নাড়া দিয়েছিল। বিধবা বিবাহের পক্ষে তার প্রবন্ধ ছিল “বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব”। এই বইয়ে বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে সকল যুক্তিতর্কের পাল্টা জবাবের অবতারণা করেন। বইটি মূলত তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করে। তিনি সমাজের জন্য কতটা উদ্বিঘ্ন ছিলেন তার প্রমান পাওয়া যায় তার এ উক্তি থেকে, “বিধবা বিবাহের প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম, জন্মে ইহার অপেক্ষা অধিক আর কোন সৎকর্ম করিতে পারিব তাহার সম্ভাবনা নাই; এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙ্মুখ নই।” উক্তিটি থেকে বিদ্যাসাগরের চরিত্রের অসাধারণ দৃঢ়তারও পরিচয় মেলে। বিদ্যাসাগরের আপ্রাণ চেষ্টার ফলে ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহের আইন পাশ হয়।
১৮৯১ সালে এই মহাপুরুষের মহাপ্রয়াণ ঘটে। শিক্ষা সংস্কার, আধুনিক শিক্ষার প্রচলন, নারী ও শিশুশিক্ষার বিস্তার ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগরের সক্রিয় ভূমিকা আজও মানুষের মনের অন্তরে বাঁধা রয়েছে। তার মহাপ্রয়াণ ঘটেছে ঠিকই কিন্তু মানুষের মনে আজও তিনি অমর।
অন্যধারা/সাগর