জাতীয় গৃহায়নের দুর্নীতির সিন্ডিকেটের হোতা আনোয়ার কোটি কোটি টাকার মালিক

বিশেষ প্রতিবেদক :
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মিরপুর ডুইপ অফিসের সাবেক দুর্নীতিবাজ ম্যানেজার আব্দুর রউফের রেখে যাওয়া সিস্টেমে বর্তমানে অফিস চালাচ্ছে তার আত্মীয় আনোয়ার ও শফিক সিন্ডিকেট। নাম না প্রকাশ করার শর্তে জাগৃকের একজন কর্মকর্তা অত্র প্রতিবেদককে আফসোস করে বলেন ” এই আনোয়ার–শফিক সিন্ডিকেট সব কাগজ ঠিক থাকলে একটি ফাইলের স্বাক্ষরে আমাকে দেয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা আর মানুষের কাছ থেকে নেয় লক্ষ টাকা। কাগজপত্রে কিছু ঘাটতি থাকলে তা উন্নীত হয়ে যায় কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে। আনোয়ার হোসেন ঘুষ দূর্নীতির টাকা দিয়ে নিজের নামে তার স্ত্রীর নাহারের নামে এবং বে নামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তুলেছেন বলে জানা যায়। এ প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেনের অফিসে গেলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উক্ত অফিসে কর্মরত একজন জানান আনোয়ার ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে পাহাড় পরিমাণ টাকা কামিয়ে উপরোস্থ অফিসারদের ম্যানেজ করে ধরাকে সড়াজ্ঞান করছেন।
ঘটনার প্রকাশ, মো: আব্দুর রউফ । জন্ম মানিকগঞ্জ জেলা । অভাবের টানাটানির সংসারে প্রথমে লবণ ব্যবসায় লস করে, পরে মানিকগঞ্জ শহরে এক আত্মীয়ের বাড়ী লজিং থেকে পড়াশোনা অতঃপর একটি বেসরকারী ব্যাংকে চাকরী নেন। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সেখান থেকেও অব্যাহতি পান।
১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনের পর বিএনপি সরকারের সময় খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বদান্যতায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ( জাগৃক ) এ চাকুরী, সেই সূত্রে মিরপুর গৃহায়নের ডুইপ প্রজেক্টে ম্যানেজারী করেন দুই যুগের উপরে। মাথার উপরে ঝুলাতেন খালেদা জিয়া ও হাওয়া ভবনের তারেক (২০০১-২০০৬ ), ফখরুদ্দিন – মইনুদ্দিন ( ২০০৭-২০০৮), প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (২০০৯-২০২০) ছবি।
সেবা প্রত্যাশী প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকার চুক্তি করতেন ফাইল প্রতি। সে সকল ফাইল নিয়ে হেড অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতেন প্রায় প্রতিদিনই ৷ মিরপুরের একাধীক স্থায়ী বাসিন্দারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ডুইপ ম্যানেজার রউফের মিরপুর-১,২,১০ ও মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটসহ ৩০০ এর মতো দোকান আছে।
তাহার সে সময়কার পি.এ চাচাত ভাই আনোয়ার এবং ডুইপ অফিস স্টাফ শালা শফিকের নামে উত্তর খানের ময়নারটেক ও কামার পাড়ায় প্রচুর জমিসহ বাড়ী বসবাসের জন্য দিয়েছেন।
বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক তৃপ্তি ও হাওয়া ভবনের কিছু অর্থ ও সম্পত্তি বেনামীতে ডুইপ প্রজেক্টে প্লট কিনে বিনিয়োগ করেন ডুইপ অফিস স্টাফ নামধারী দালাল মান্নানের নামে।
অনুসন্ধানে উঠে আসে কাওরান বাজারে রয়েছে তার আড়ত ও একাধিক দোকান। যা তিনি নিজে তদারকি করেন।
মালিকানা আছে বিলাস বহুল নিশান পেট্রল, রেঞ্জ রোভার, টয়োটা লেন্ড ক্রুজার পাজেরো সহ বেশ কতগুলো গাড়ীর। চলাফেরা করেনও তাতে।
নিজে থাকেন উত্তরার বিলাস বহুল বাড়ীতে। দাবী করেন নিজেকে উত্তরা সেক্টর বাড়ি মালিক সমিতির সভাপতি।
ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজ আব্দুর রউফ বিয়ে করেছেন নেত্রকোনা জেলায়। তার দুই ছেলে। তাদের রেখেছেন কানাডায় তার দুর্নীতির টাকায় কেনা বেগম পাড়ার একাধিক সম্পত্তি দেখাশোনা ও রক্ষনাবেক্ষণ করতে। সম্পত্তি রক্ষা করার নিমিত্তে ছেলেদের বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তা ও সক্ষতা গড়েছেন পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে এবং পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর তার আত্নীয় – ব্যবসায়িক পার্টনারশিপ আছে বলে বেড়ান এবং প্রচলিত আছে।
অতি সম্প্রতি তার স্ত্রীর ছোট ভাই রফিকুলকে বিপুল টাকা ঘুষ রফা দফা করে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের হিসাব বিভাগে সহকারী হিসাব রক্ষক পদে সরকারী চাকুরী দিয়ে ঢাকার মোহাম্মাদপুর জাগৃক প্রশাসনিক কর্মকর্তার কার্যালয়ে পদায়ন করেন এই দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাবান সাবেক ডুইপ ম্যানেজার আব্দুর রউফ।
একই সাথে আবার তার মনোনীত প্রায় ১৫০ জন নিজের এবং স্ত্রীর বাড়ির পুরুষ ও মহিলাকে অরজিত দুর্নীতির টাকা থেকে বিমান রিজার্ভ করে হজ্জ করিয়ে নিয়ে আসেন।
এদের আবার আছে পালিত দালাল চক্র। নেতৃত্ব দেয় দালাল মান্নান। নিজেকে দাবী করে অফিসার। নিয়মিত সময় ধরে অফিস করে জাগৃকের ডুইপ আনোয়ার – শফিক সিন্ডিকেটের সাথে টেবিল চেয়ার নিয়ে।
প্রতিদিন অর্জিত ঘুষের টাকার ভাগের অংশ পৌছে দেওয়া হয় এই ক্ষমতাবান মাফিয়া দুর্নীতিবাজ সাবেক ডুইপ ম্যানেজার আব্দুর রউফের কাছে। যা দিয়ে দিনের পর দিন ফুলে ফেপে উঠেন তিনি। সাধারণ মানুষের রক্ত – ঘামের টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার করে গড়ে তুলছেন বিপুল সাম্রাজ্য।
অভিযোগ আছে, আনোয়ার টাকা ছাড়া প্রতিবেদন দেন না। যে কাজ করতে খুব বেশি সময় দরকার হয় না তা তিনি ৬ মাস আটকে রাখেন।
জানা গেছে, এক ব্যবসায়ীর মায়ের কাছ থেকে হেবা দলিলের মাধ্যমে মিরপুর সেকশন-১, ব্লক-ক (উত্তর বিশিল)-এর ৫৯নং পুনর্বাসন প্লটটি নিজের নামে করার পায়তারা চালান আনোয়ার। এ জায়গাটি ছিল মূলত জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের। সংস্থাটি থেকে সরকারি নিয়ম মেনে প্লটটি কিনেছিলেন মো. খবির উদ্দিন নামে একজন ব্যবসায়ী। তার কাছ থেকে জয়নাল আবেদিনের বাবা মো. সাইদ কাজী ১৯৮১ সালের ৬ আগস্ট কিনে নেন। এর পর তিনি স্ত্রী ফয়জন নেছার নামে দলিল করে দেন। তবে প্লটের মূল মালিকানা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিক্রি ও হস্তান্তর হয়। নিয়মানুযায়ী গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্লট বিক্রি করতে হলে সংস্থার অনুমতি লাগে। কিন্তু খবির উদ্দিন নিয়ম মানেননি। যিনি কিনেছেন তিনিও তা যাচাই করেননি।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ লিজ দলিলের মাধ্যমে খবির উদ্দিনকে প্লটটি হস্তান্তর করেছিল। তাই পরবর্তী বসবাসকারীকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। যখন কাজী জয়নাল আবেদিনের নামে নামজারি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখনই বেরিয়ে আসে প্লটটির হস্তান্তর সংক্রান্ত এই জটিলতার বিষয়টি।
ক্রয়সূত্রে মালিক ফয়জন নেছা গত বছর তার ছেলে কাজী জয়নাল আবেদিনের নামে প্লটটি লিখে দেন। তাই নিজের নামে নামজারি করতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে জাগৃকে আবেদন করেন জয়নাল আবেদিন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে জাগৃক উপপরিচালক আরএম সেলিম শাহনেওয়াজ স্বাক্ষরিত একটি অফিস আদেশ দেওয়া হয় চলতি বছর ২২ জানুয়ারি। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মিরপুর হাউজিং এস্টেট প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামানকে চিহ্নিত করে অফিস আদেশ জারি করা হলেও, আদেশের তোয়াক্কা না করে আনোয়ার প্লটটিতে কে বা কারা কিসের ভিত্তিতে বসবাস করছেন বা দখলে রেখেছেন, প্লটটির যাবতীয় কর ও খাজনা পরিশোধ করা হয়েছে কিনা ইত্যাদি নিজেই তদারকি করেন মূলত প্লট আনোয়ার প্লটটি হাতিয়ে নেওয়ার নিমিত্তে।
জাল দলিলে বেহাত হওয়া জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) একের পর এক প্লট হাতিয়ে নেওয়ার পায়তারার অভিযোগও রয়েছে আনোয়ারের বিরুদ্ধে।
নথি ও কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে সরকারি জমি নিজের ও নিকট আত্মীয়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করার মতো অপরাধ করেন আনোয়ার।
জাগৃকের ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা শাখার সদস্য (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ কুদ্দুছ আলী সরকার এ প্রতিবেদককে জানান, ‘জালিয়াতির কিছু ঘটনা ঘটেছে। সেখানে আমার স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে। সবকিছু পর্যালোচনা করে জাল-জালিয়াতির কার্যক্রমগুলো বাতিল করা হবে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অনুসন্ধানে গভীরে গিয়ে জানা যায়, মূল নথি গায়েব করে জাল নথি তৈরির কাজও করে আনোয়ার ও তার সহযোগীরা। নথির সবখানে ইস্যু নম্বর তৈরিসহ ঘষামাজা করে বরাদ্দপত্র জারি করা হয়।
শুধু তাই নয়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ একাধিক দালাল সিন্ডিকেট রয়েছে। আর এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন আনোয়ার। সাধারন সেবা প্রত্যাশী নিরীহ অসহায় মানুষদের ও বাধ্য করছেন নির্ধারিত অঙ্কের ঘুষ গুনতে । এসব ঘুষ গ্রহণ করছেন জাতীয় গৃহয়ন কর্তৃপক্ষের আনোয়ার। বড় বিষয় হলো সকলের বদলী হলেও কোনো এক অদৃশ্য কারনে এই আনোয়ার একই অফিসে বহুবছর ধরে দাপটের সহিত চাকুরী করছে এর পিছনের শক্তি কি এই প্রতিবেদক জানতে চায় কর্তৃপক্ষের নিকট। কিন্তু তার উত্তর মেলেনি।

সংবাদের সততা যাচাইয়ের জন্য এ প্রতিবেদক সকলের সাথে মোবইল ফোনে এবং সাক্ষাতে যোগাযোগ করলে ঘটনার আংশিক সত্যতা স্বীকার করে পাশ কাটিয়ে যান। এ প্রতিবেদককে নিউজ না প্রকাশের জন্য কিছু টাকাও অফার করেন, রাজী না হওয়ায় প্রাণ নাশের হুমকী ধামকী ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন।

১৭/০৭/২০২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here