মুহাম্মদ আবু আদিল, বিশেষ প্রতিনিধিঃ ক্রিকেটের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ও অভিজ্ঞ সেনানী মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন। দীর্ঘ ১৭ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টানার মাধ্যমে তিনি শেষ করলেন এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। তাঁর বিদায়ে কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর মনে এক গভীর শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
অভিষেক ও ক্যারিয়ারের শুরু
২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। শুরুতে তিনি মূলত ছিলেন একজন বোলিং অলরাউন্ডার, যার ভূমিকা ছিল মিডল অর্ডারে ব্যাট করা ও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে বল হাতে উইকেট নেওয়া। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যাটিং দক্ষতাকে শানিত করে হয়ে উঠেছেন দলের অন্যতম ভরসার প্রতীক।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহর পরিসংখ্যান
তিন ফরম্যাটেই মাহমুদউল্লাহ ছিলেন দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাঁর পরিসংখ্যানই বলে দেয়, কেন তিনি ছিলেন এত নির্ভরযোগ্য—
ওয়ানডে: ২৩৯ ম্যাচ, ৫৬৮৯ রান, গড় ৩৬.৪৬, স্ট্রাইক রেট ৭৬.৪৭, ৪টি সেঞ্চুরি, ৩২টি ফিফটি।
টেস্ট: ৫০ ম্যাচ, ২৯১৪ রান, গড় ৩৩.৪৯, ৫টি সেঞ্চুরি, ১৬টি ফিফটি।
টি-টোয়েন্টি: ১৪১ ম্যাচ, ২৪৪৪ রান, গড় ২৩.৭৭, স্ট্রাইক রেট ১১৭.৩৮।
বোলিং: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোট ১৫২টি উইকেট শিকার।
স্মরণীয় মুহূর্তগুলো
মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারে অনেক গৌরবময় মুহূর্ত আছে, তবে কিছু স্মৃতি চিরকাল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।
✅ ২০১৫ বিশ্বকাপে ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি
২০১৫ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটি ছিল দেশের ক্রিকেটের জন্য এক মাইলফলক। সে ম্যাচে চাপের মুখে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে মাহমুদউল্লাহ প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করেন। তাঁর ১০৩ রানের ইনিংস ও রুবেল হোসেনের বিধ্বংসী বোলিং ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দেয় এবং বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে দেয়।
✅ ২০১৫ বিশ্বকাপে টানা দুই সেঞ্চুরি:
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ইনিংসের পর ভারতের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালেও মাহমুদউল্লাহ আরেকটি সেঞ্চুরি করেন। সেই বিশ্বকাপে তাঁর পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
✅ ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স
২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মহাকাব্যিক জয় এনে দেওয়া ইনিংসটি ভুলার নয়। সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ২২৪ রানের অবিস্মরণীয় পার্টনারশিপ গড়ে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো আইসিসি টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে তুলেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। সে ম্যাচে তিনি ১০২ রানে অপরাজিত ছিলেন।
✅ ২০১৮ নিদাহাস ট্রফিতে ‘নাগিন নাচ’ এবং শেষ বলের ছয়
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিদাহাস ট্রফির উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে শেষ বলে মাহমুদউল্লাহর ছক্কা বাংলাদেশকে ঐতিহাসিক জয় এনে দেয়। তাঁর ব্যাট থেকে আসা সেই ছক্কা ও ম্যাচশেষে ‘নাগিন নাচ’ উদযাপন আজও ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে দোলা দেয়।
✅ টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত
২০২১ সালে হারারে টেস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৫০* রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে টেস্ট ক্যারিয়ারকে স্মরণীয় করে রাখেন। এটি ছিল তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংস, যা বাংলাদেশকে বড় জয় এনে দেয়।
নেতৃত্বগুণ ও ব্যক্তিত্ব
মাহমুদউল্লাহ শুধু একজন দক্ষ ক্রিকেটারই নন, তিনি ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য নেতা। চাপের মুখে শান্ত থাকার বিরল ক্ষমতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখনই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তখনই তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে সুপার ১২ পর্বে তুলতে তাঁর নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কেন মাহমুদউল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার?
★চাপের মুখে পারফর্ম করার অসাধারণ ক্ষমতা।
★আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স।
★দলকে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া।
★অলরাউন্ড দক্ষতা—ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি কার্যকরী বোলিং।
★সতীর্থদের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ও দৃঢ় মানসিকতা।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও সতীর্থরা মাহমুদউল্লাহকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাঁর সতীর্থরা আবেগঘন পোস্ট ও ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, মাহমুদউল্লাহর অভাব পূরণ করা কঠিন হবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে অবদান
মাহমুদউল্লাহ শুধু একজন দক্ষ অলরাউন্ডারই নন, তিনি ছিলেন একজন দুর্দান্ত নেতা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল একাধিক স্মরণীয় জয় পেয়েছে। ধৈর্য, দায়িত্ববোধ এবং চাপের মুখে পারফর্ম করার অসাধারণ ক্ষমতা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।
মাঠের লড়াই শেষ হলেও, মাহমুদউল্লাহর স্মৃতি চিরকাল থাকবে ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেট তাঁকে আজীবন মনে রাখবে।
শুভ বিদায়, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ! আপনার অবদান চিরকাল অমলিন থাকবে।