জন্মদিন পরিবার
নম্রতা সাহা
জন্মদিন পালন করতে কে না ভালবাসে… কিন্ত তারও একটা সীমা আছে! ফেসবুক খুললেই প্রতিদিনই মুখার্জিবাবুর বাড়িতে জন্মদিন পালনের ছবি। হাতে গোনা কয়েকদিনের ডিফারেন্সে বাড়ির এক এক সদস্যের জন্মদিন…। মুখার্জিবাবুর মা-বাবা থেকে শুরু করে ছোটনাতি-নাতনি অবধি সবার জন্মদিন বেশ আড়ম্বরের সঙ্গেই পালন হয় ওই বাড়িতে, কাকা-জ্যাঠা, পিসি-মাসি কেউই বাদ যায়না- জয়েন্ট ফ্যামিলি বলে কথা। যেদিন যার জন্মদিন সে একেবারে সেজেগুজে মধ্যমণি হয়ে বসে থাকে, তার সামনে এলাহি সব মেনু থরে থরে সাজানো, তাকে ঘিরে বাকি সদস্যরা- তারপর ফটোসেশন- এভাবেই চলে জন্মদিন পালন। প্রথম প্রথম আত্মীয়-স্বজনেরা এটাকে মজার ছলে নিলেও ক্রমশ খুব বিরক্ত হতে শুরু করেন- আজ এর জন্য গিফট কিনতে হচ্ছে তো কাল তার জন্য। ক্রমে করোনা’র জন্য লকডাউন জারি হওয়ায় তারা একপ্রকার হাফ ছেড়ে বাঁচলেন- ভিডিও কলিং এ বার্থডে উইশ। কিন্ত এরকম করে আর কদিন! মুখার্জিবাবু কিছুতেই সাদামাটা ভাবে জন্মদিন পালন করবেন না বলে ঠিক করলেন- কিন্ত এই লকডাউনের মধ্যে তিনি কী বা করবেন…। একদিন বিকালে চা খেতে খেতে হঠাৎ করে একটা আইডিয়া এলো- কোভিড পরিস্থিতিতে তো সব বন্ধ কিন্ত বাড়ি বসে অনলাইন জন্মদিন পালন তো করাই যায়। ব্যাস, আবার শুরু হল জন্মদিন পালন। সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘মুখার্জি ফ্যামিলির বার্থডে সেলিব্রেশন’ খুব ফেমাস হতে শুরু করল। লাইক-কমেন্টের বন্যা বয়ে গেল। ফলোয়ারসদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সোশ্যাল মিডিয়াতে তারা আগের মতই সচল। এত আনন্দ, এত খুশি, সকলের ভালবাসা- এসবের মধ্যেও সেদিনের একটা ঘটনা মুখার্জিবাবুকে একদম বদলে দিল।
মুখার্জিবাবুর ছোটনাতির জন্মদিনের দিন বেশ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল, যাদের আসার কথা কেউই আর আসতে পারলো না – একগাদা খাবারের আয়োজন সব নষ্ট হল। বাধ্য হয়ে সেগুলো ডাস্টবিনে ফেলে আসতে হল। পরেরদিন মুখার্জিবাবু বাজার করতে বেড়িয়ে দেখলেন রাস্তার ধারের ওই ডাস্টবিন, যেখানে গতকালের অতগুলো খাবার ফেলা হয়েছিলো, সেখান থেকে একটা বাচ্চা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। বাচ্চাটা তার নাতিরই বয়সী, কিন্ত দু’জনের মধ্যে চরম বৈপরীত্য। বাচ্চাটাকে ডাকতেই চমকে উঠলো। ভয় কাটানোর জন্য মুখার্জিবাবু সামনের দোকান থেকে একটা কেক কিনে বাচ্চাটাকে দিলো। ওইভাবে ডাস্টবিন থেকে খাবার খাওয়ার কারণ জানতে চাইলে জড়তা কাটিয়ে বাচ্চাটা মুখার্জিবাবুকে বলল, “আজ আমার জন্মদিন, ভালই হল কেক খেতে পারলাম। বাবার তো লকডাউনে কাজ চলে গেছে তাই আমরাও আর ভালমন্দ খেতে পারি না- এখানে অনেক ভালো ভালো খাবার পড়েছিল তাই…”। ওই বাচ্চা ছেলেটা মুখার্জিবাবুর মনটাকে একেবারে নাড়িয়ে দিল। বাড়ি ফিরে তিনি আরও অস্থির হয়ে উঠলেন- এভাবে এরকম পরিস্থিতে কত লোক কাজ হারিয়েছেন, কত লোক দু’মুঠো খাবারের জন্য কত কষ্ট-পরিশ্রম করেন- আর তিনি কিনা হেলায় এত সব খাবার নষ্ট করছেন। মুখার্জিবাবুর নিজেকে কেমন যেন অপরাধী বলে মনে হতে লাগলো। মনকে শান্ত করতে বিকেলে নদীর ধারে বসে ভাবতে থাকলেন…। ভাবতে ভাবতে এক অসাধারণ উপায় খুঁজে পেলেন তিনি। সামনেই তার নাতনির জন্মদিন- ওই দিনই করতে হবে যা করার। বাড়ি ফিরে সকলকে তার মনের কথা জানালেন। সকলেই মুখার্জিবাবুর এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। নির্ধারিত দিনে মুখার্জিবাবু সপরিবারে বেড়িয়ে পরলেন একটু অন্যভাবে প্রকৃতির কোলে নাতনির জন্মদিন পালনের জন্য।
এতদিন ধরে বাড়ির মধ্যেই সব অনুষ্ঠান হত, এই প্রথম তারা বাইরে কোথাও গিয়ে সেলিব্রেট করবে। সেখানে আগে থেকেই সব বন্দোবস্ত করা ছিল। নাতনির হাত দিয়ে মুখার্জিবাবু সেদিন প্রায় একশো দুঃস্থ বাচ্চাকে খাবার, জামা-কাপড়, বই-খাতা, ব্যাগ তুলে দিলেন। এর সঙ্গে মুখার্জিবাবু বললেন যে প্রতিবার এভাবেই তিনি জন্মদিন পালন করবেন, অত সাজসজ্জা-আড়ম্বরের কোন মানে নেই- ওতে কারোর ভালো হয়না, সকলের উপকারে লাগতে পারাই আসল ভালো। গতবারের জন্মদিন গুলোর মত এটাও নিয়ম মত সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হল। এটা যেন সকলের মন ছুঁয়ে গেল। চারিদিকে ‘মুখার্জি ফ্যামিলির বার্থডে সেলিব্রেশন’ আরও ফেমাস হল। তাদের ভিডিওতে কমেন্টের ঝড় শুরু হল- “থ্রি চেয়ারস ফর ‘জন্মদিন পরিবার’ হিপ হিপ হুররে…”।
দৈনিক অন্যধারা/১১ জুন ২০২২/জ কা তা