কবি শাহীন রেজা ও তার একান্ত ভুবন
জাকির আবু জাফর
(ছবি: কবি শাহীন রেজা)
কবি শাহীন রেজার রয়েছে একটি একান্ত ভুবন। যা তার নিজস্ব আনন্দে কল্লোলিত। যার আনন্দ রয়েছে তার বেদনাও থাকে। কেননা বেদনাই মানুষকে আনন্দের স্বাদ নিতে যোগ্য করে। সুখ যেমন ভোগ্য বিষয়- বেদনাও গ্রহণের বিষয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘অকারণ আনন্দভার বিধাতা যাহারে দেন তার বক্ষে বেদনা অপার।” শাহীন রেজার বুকে অকারণ আনন্দ আমি দেখেছি। এ আনন্দ কবিতার। এ আনন্দ কবির আপন পৃথিবীর। যে পৃথিবীর আলো বাতাস রোদ বৃষ্টি রাত ও জোছনার যৌবন সবই কবির সাথী। সবই বিষাদ ও বন্ধনের আশ্চর্য প্রেরণা। কবি ইচ্ছে করলেই কোকিলের কুহু ধ্বনির তরঙ্গে কান পাতেন। অজস্র কোলাহলের ভেতর বহন করেন স্তব্ধতার ভার। এবং নিশির শরীরে ঘুঘুর নিঝুম দুপুর বেজে ওঠে কবির বুকে। এইতো কবির পৃথিবী। এইতো কবির একান্ত সুখ। শাহীন রেজা এ সুখে সুখী একজন কবি। এবং এ বেদনায় কাতর একজন কবিতাকর্মী।
কবিতার আনন্দের মত আনন্দ পৃথিবীতে কী আছে জানি না। কিন্তু একজন কবির অন্তরের যে ঐশ্বর্য তার মত কিছু আর নেই একথা দ্বিধাহীন বলা যায়। কবি শেলী বলেছেন- কবি হচ্ছে বুলবুলি পাখির মতো- যে অন্ধকারে বসেও মধুর কলগানে চারিদিক মুখর করে তোলে। এবং এমারসন বলেছেন- কোনো কবি এবং তার কবিতার ভুবনে দরিদ্র থাকে না। সুতরাং কবিতার জগৎ বিস্ময়কর জগৎ। কবির জগৎ বিস্ময়েরও অধিক। প্রতিটি কবিই এমন বিস্ময়কর জগতের অধিপতি। একজন কবি এ বিস্ময় জাগিয়ে দেন মুহূর্তের ভেতর। শাহীন রেজা কবিতার জন্য তার অন্তর দীর্ঘ করে তুলেছেন। জটিল জীবনে যত যন্ত্রণাই থাকুক শেষ পর্যন্ত কবিতার কাছে সমর্পিত তিনি। কবিতাই তার আনন্দ বেদনার প্রতীক হয়ে জেগে থাকে। জেগে আছে। এবং সম্ভবত: জেগে থাকবে। শেলীর আরেকটি উক্তি না বলে পারছি না। তিনি বলেছেন- পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মহৎ কবিতা তাকে চিরঞ্জীব করে রাখে। কবিতার এ শক্তির খবর শাহীন রেজা জানেন। জানেন বলেই তিনি কবিতায় নিজেকে নি:শেষ করার স্বপ্ন আঁকেন। শেষপর্যন্ত কবিতার সাথেই তার সখ্য। তার প্রেম। তার ভালোবাসার সমস্ত নদীগুলো। তার গ্রহণ বর্জনের অভিরুচি এবং তার বিশ্বাস অবিশ্বাসের যাবতীয় সূত্রাবলী।
নগর জীবন মানুষের জীবন থেকে কেড়ে নিলো অবসর। দিনরাত ব্যস্ততার ঘষটানি। বিনিময়ের রুদ্ধশ্বাস। কেবল ছুটে চলাই জীবন এ সত্য এ নগরে ধ্রুব। সুতরাং নাগরিক মানুষেরা ছুটছে আর ছুটছে। কারো হাতে অবকাশে খরচ করার মতো সময় নেই। আড্ডায় ব্যয় করার মতো নেই সামান্য মুহূর্ত। অথচ একজন কবি যেনো অবকাশেই বেঁচে থাকেন। অবকাশই কবির শ্বাস প্রশ্বাস। পানি যেমন মাছের। কবিও তেমনি কবিতার এবং অবকাশের। আড্ডা আসর আর অবসরের ভেতর যেনো স্বপ্নের পৃথিবী রচনা করেন কবিরা। শাহীন রেজা এ গোত্রেরই একজন। তিনি নাগরিক অথচ নগর তাকে ব্যস্ততার ডিবিতে ঠেলতে পারেনি। শুধু বিনিময় তাকে কখনো কাতর করেনি। কবিতার আড্ডায় আসরে শাহীন রেজা সরব। শুধু অংশগ্রহণ করেন তাই নয় অংশগ্রহণ করানোর আয়োজনও করে থাকেন। এসব আয়োজনে উৎসাহের সাথে আসেন কবিরা।
গ্রহণ বর্জন এবং রুচি অভিরুচির কথা আমি তুলেছি। তুলেছি সচেতনতার সঙ্গেই। আমি জানি শাহীন রেজার অভিরুচির খবর। আড্ডাই আমাদের এসব সুযোগ হাজির করেছে। যখন আড্ডায় বসি দীর্ঘ হতে থাকে আমাদের আড্ডার শরীর। কতটা সময় খেয়েছে আড্ডা এ জিজ্ঞাসা উত্থাপন করে না মন। আমরা মজে থাকি আড্ডার ভেতর। অনেক সময়ই আমাদের এসব আড্ডার মধ্যমণি থাকেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। আড্ডায় যারা একাকার হয়ে যান তাদের ক’জন হলেন গল্পশিল্পী মাহবুব তালুকদার, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি মাহবুব হাসান, কবি শাহীন রেজা, কবি আমিনুর রহমান, কবি নূরুল হক, কবি ইদ্রিস সরকার, কবি সুহৃদ সরকার, কবি জামসেদ ওয়াজেদ, কবি কামরুজ্জামান, কবি সোহেল মামলুক, কবি ফরিদ ভূঞা ।
এসব আড্ডায় আনন্দের সাথে যোগ ঘটে প্রাণের। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেছেন তার বিদ্রোহী কবিতায়- “আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস” অথবা “আমি চিরশিশু চির কিশোর।” এসব আড্ডায় আমরা প্রাণ খোলা হাসি উল্লাসে চির কিশোরের মত উচ্ছ্বসিত হই। শাহীন রেজা আমাদের এসব আনন্দের অন্যতম অংশীদার। কখনো কখনো আড্ডাকে ডেকে বসান শাহীন রেজাই। নিজের কণ্ঠকে মোবাইলে চড়িয়ে বলেন, কি খবর? কোথায়? তারপরের আহ্বান অমুক জায়গায় আসতে হবে। ফজল ভাই এখানে। অথবা অফিসে আসছি। আড্ডা হবে নীচে ‘মানিক মিয়ার’ রেস্টুরেন্টে। হ্যাঁ আড্ডা। নির্মল আনন্দের আড্ডা। কবিতার আড্ডা। কবিদের আড্ডা। অতীত স্মৃতি থেকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা সবই আড্ডায় এসে পড়ে। এসব আড্ডা থেকেই জানা যায় একজন কবির রুচি অভিরুচির খবর। শাহীন রেজার রুচি কবিতার সাথে মানানসই এ কথা আমি বলতে পারি। কবি-সুলভ আনন্দ তাকে সজিব রাখে। তিনি অলস নন। অকর্মাও নন। তিনি নিরলস আড্ডাবাজ। কর্মের ক্ষেত্রেও নিরলস।
মানুষ তার কর্মের সন্তান- একথা বলেছেন সিসেরো। কর্মই মানুষের পরিচিতির মাধ্যম। একজন কবির কর্মের ক্ষেত্র তার কবিতার জগৎ। কবিতাই কবির একমাত্র অভিধা। একজন কবির প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবকিছু কবিতার ভেতর দিয়ে পল্লবিত। এ সত্যকে গ্রহণ করেছেন শাহীন রেজা। ফলে কবিতার ক্ষেত্রে নিরলস তিনি। কবিতাকর্মকে নিজের ভাগ্যের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। কবিতাই তার পরিচয়ের প্রকাশক।
একজন কবির চলন বলন সবই কবিতার অন্তর্গত। কবিতায় নিহিত আনন্দের সৌন্দর্যই ঘিরে রাখে কবিকে। মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলীর সাথে কবিতার গুণাবলী যোগ হলেই একজন কবি হয়ে যান শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিনিধি। এ পথই শাহীন রেজার পথ। এ পথেরই একজন পথিক তিনি। যে পথ চেনে পথের ভয় নেই তার।
দৈনিক অন্যধারা/২৮ মে ২০২২/জ কা তা