বিলগ্যারকা পাড়ের ইসলামপুর গ্রামের মৎস্যজীবী মনির হোসেন জানান, বিলে এবার গত বছরের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ পানি কম। যার ফলে তারা খুব কম মাছ পাচ্ছেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আর দুই মাস পরে বিলে হয়তো মাছই পাওয়া যাবে না।
আরেক মৎস্যজীবী রানা মোল্লা জানান, গত বছরের তুলনায় এবার বিলে ৭-৮ হাত পানি কম। এত কম পানি থাকায় মাছের উৎপাদনও কম হয়েছে। তারা বিলে খুবই কম মাছ পাচ্ছেন।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলনবিল অধ্যুষিত পাবনা জেলা থেকে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে ৩০ প্রজাতির মাছ। এক সময় একশো প্রজাতির ওপরে মাছ পাওয়া যেত জেলায়। সময়ের পরিবর্তনে নদীর পাড় দখল, বিলের মাঝ দিয়ে রাস্তা নির্মাণ, অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন, অধিক ফলনের আশায় জমিতে কীটনাশক প্রয়োগসহ নানা কারণে হারিয়ে যেতে থাকে বিভিন্ন দেশি প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ।

জেলা মৎস্য অফিস থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, পাবনায় ১০৬টি খাল রয়েছে। আর এর দ্বিগুণ পরিমাণে ২১২টি বিল রয়েছে। প্রায় ৩৭ হাজার পুকুর রয়েছে। ২৩৩টি প্লাবনভূমি রয়েছে। ৬৩৫টি বড়পিট (বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংলগ্ন খাল), আটটি মৎস্য অভয়াশ্রম রয়েছে। জেলায় ২১ হাজারের বেশি মাছ চাষি রয়েছেন। মৎস্যজীবী বা জেলের সংখ্যা ৩৪ হাজারের বেশি। জেলায় প্রতিবছর গড়ে ৬৮ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ছয় হাজার টনের বেশি মাছ উদ্বৃত্ত থাকে।
সুজানগর উপজেলার বিল গাজনা পাড় এলাকার চিনাখড়া বাজারের মাছের আড়তদার আ. লতিফ জানান, তারা সিলভার কার্প, পাঙাস ছাড়াও পুকুরে চাষ করা রুই, কাতলা, মৃগেল, কই, মাগুর ইত্যাদি স্থানীয় মাছ চাষিদের কাছ থেকে কিনে পাইকারি বাজারে বিক্রি করেন। এখন টেংরা, পাবদাসহ দেশি প্রজাতির বেশকিছু মাছ পুকুরেই চাষ হচ্ছে। চাষিরা সম্পূরক খাবার খাইয়ে এসব মাছ বড় করেন।

এক প্রশ্নের জবাবে লতিফ বলেন, বেশ কয়েক বছর থেকে বিলে মাছের অভাব দেখা দিয়েছে। এবার বিলে পানি কম থাকার কারণে দেশি জাতের মাছের খুবই অভাব।
সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে দেশি মাছ কিনতে আসা মোকাদ্দেছ মোল্লা (৭০) বলেন, বাজারে তো আগের মতো দেশি জাতের মাছ নেই। বিলে পানি নেই, তাই মাছ কম। আর যে মাছ আছে সেগুলোও চায়না দোয়ারি জাল দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে।
তিনি এটাও জানান, একেবারে ছোট ছোট মাছ ধরছে জেলেরা। এখন পোনাসহ মা মাছ ধরছেন তারা। কিন্তু ২-১ মাস পরে তো বিলে মাছই পাওয়া যাবে না। কারণ এখন চায়না দোয়ারি জাল দিয়ে তারা মাছ ছেঁকে নিয়ে আসছে।
বাজারে মাছ কিনতে এসে একই রকম কথা বললেন সাঁথিয়া উপজেলার শোলাবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণলাল কর্মকার (৪৩)। তিনি বলেন, এখন বিলের মাছ খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে। বিলে পানি কম, সেজন্য মাছও কম। কিন্তু যেগুলো আছে সেগুলোও চায়না দোয়ারি জালের মতো সুক্ষ্ম জাল দিয়ে মেরে নির্বংশ করে ফেলা হচ্ছে।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল এবং পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাহিদুল ইসলাম বলেন, গত ৮০ বছরের মধ্যে পাবনায় এবার সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে পানি কম হওয়ায় খালে-বিলে এবার মাছ কম। মুক্ত জলাশয়ে মাছ কমার জন্য মানবসৃষ্ট কিছু কারণও রয়েছে। এখন এলাকার ছোট-ছোট খাল-বিলে বাঁধ দিয়ে বা ঘের বানিয়ে অনেকে মাছ চাষ করেন। সেটা লিজ নিয়ে হোক বা জবর দখল করে হোক। এতে মুক্ত জলাশয়কে আবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বিলের বা মুক্ত জলাশয়ের প্রাকৃতিক মাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বিচরণ করে। কিন্তু তা রুদ্ধ করে ফেলায় মাছের প্রজনন বিঘ্নিত এবং প্রজনন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতে দেশি জাতের সব মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।
ড. রাহিদুল আরও বলেন, অদূর ভবিষ্যতে জেলায় আমিষের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এছাড়া মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি নানা জলজ সম্পদও বিলুপ্ত হতে পারে। ফলে প্রকৃতি হারাতে পারে ভারসাম্য। এজন্য কারেন্ট জাল, চায়না দোয়ারি জাল ব্যবহার বন্ধ করা, প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ না ধরা, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ না করা, জলাশয় সংলগ্ন রাসায়নিক সারের ব্যবহার রোধ করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
এ বিষয়ে পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাছ উৎপাদনে পাবনা জেলা এগিয়ে। এ জেলা থেকে উৎপাদিত মাছ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়। প্রায় হারিয়ে যাওয়া বহু প্রজাতির মাছ এখন পুকুরে চাষ করা হচ্ছে। মাছ চাষে বিপ্লব ঘটেছে পাবনায়। এজন্য তারা বহু মাছ চাষিকে প্রশিক্ষিত করেছেন।
তিনি আরও বলেন, তবে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কিছু কারণে মুক্ত জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ কমে গেছে। এবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি কমের কারণে বিলগুলোতে পানি কম। বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্টজাল দিয়ে মা মাছ নিধনের ফলেও বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি মাছ। কিছু অসাধু ব্যক্তি এখন চায়না দোয়ারি জাল ব্যবহার করছে। এর বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চলছে।
দৈনিক অন্যধারা/১২-১০-২০২২ইং