মেয়েটির আত্মা খুব বিরক্ত করছে

- Advertisement -
- Advertisement -

লেখা : খান রিফাত

‘সোজা একটা কোপ দিই মানুষটার ঘাড়ে। পড়ে যান। পা দিয়ে চেপে ধরি তাকে মাটির সঙ্গে, ছুরিটা গলায় চালিয়ে দিই আবার। শরীর থেকে আলাদা করে ফেলি পুরো মাথাটা। ঘটনাটা ঘটে ঠিক তখনই।’

সক্রেটিসের মতো ঈষৎ বের হওয়া চোখে মিলন সাহেব সামনে তাকালেন। হাতের সিগারেটটা ঠুকতে লাগলেন বাঁ হাতে চেপে ধরা দেশলাইয়ে। ওপরের ঠোঁটে কিঞ্চিৎ নেমে আসা গোঁফগুলোতেও হাত বুলিয়ে নিলেন একবার। কিন্তু হাতটা ওখানেই রইল, গোঁফ ঘেঁষে, ঠোঁট ছুঁয়ে। মুখে ঢুকে যাওয়া কোনো একটা কুটো ফেলে দিলেন থু করে, ‘তারপর মাথাটা কথা বলতে শুরু করল।’

‘জি। তবে সঙ্গে সঙ্গে বলেনি। কিছুক্ষণ ওটা মাটিতে পড়ে ছিল। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল কাটা জায়গাটা থেকে। সাদা শ্বাসনালিটাও কাঁপছিল তিরতির করে। হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ায় মাথাটা। হেঁটে আসার মতো মাটি ঘষতে ঘষতে এগিয়ে আসে আমার দিকে। কাতর গলায় বলে, “এভাবে তো আমাকে মারার কথা ছিল না, আঙ্কেল!”’

‘কথা বলার সময় কাটা মাথাটার চোখ দুটো কি খোলা ছিল?’

‘খোলা তো ছিলই, পিটপিটও করছিল ও দুটো।’

মিলন সাহেব হাতের সিগারেটটা মুখে ঢোকালেন। দুই ঠোঁটে চেপে স্থির হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। সামনে বসা মানুষটার দিকে আরেকটু মনোযোগ দিলেন— সাজ্জাদ এস ডি, বয়স ৪২, স্বাস্থ্য ভালো, উচ্চতা মাঝারি, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের সাপ্লাইয়ার।

‘এস ডি সাহেব।’ সিগারেটে আগুন ধরালেন মিলন সাহেব। দুই ঠোঁট কিঞ্চিৎ সরু করে মুখের ধোঁয়াগুলো ছাড়লেন বাতাসে। তাকিয়ে রইলেন গোল গোল রূপ নেওয়া ধোঁয়াতে, কিন্তু তার মনোযোগ আর চোখের স্থিরতা দেখে মনে হলো, ওগুলো ধোঁয়া না, তাকে ছেড়ে চলে যেতে চাওয়া অনেক দিনের আপনজন।

‘এই খুনের আগে আপনি আর কোনো খুন করেছেন কখনো?’

‘এই খুনের আগে মানে!’ ভ্রু দুটো সংকুচিত করে ফেললেন এস ডি , ‘আপনি এটাকে খুন ভাবছেন, স্যার?’

‘আপনার কি মনে হয়, এটা খুন না?’

‘না, এটা খুন না।’

‘তাহলে?’

‘আপনার “তাহলে”র উত্তরটা আমি দিতে চাচ্ছি না, স্যার। কারণ, আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাতের মতো এক হাজার একটা যুক্তি দেখালেও আপনি বা আপনারা আমার কোনো যুক্তিই আমলে নেবেন না। যদিও আপাতদৃষ্টে এটা খুনই।’

কিঞ্চিৎ নেমে আসা গোঁফগুলোতে হাত বোলালেন মিলন সাহেব, ‘এই মুহূর্তে আপনার কোনো ইচ্ছে আছে?’

‘ইচ্ছে বলুন আর সাধ বলুন—একটাই। তিন দিন ধরে আমার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে, হাত দুটোও বাঁধা। চোখ দুটো খুলে দিলে ভালো হয়। দুনিয়াটা দেখে যেতে চাই শেষবারের মতো।’

‘শেষবারের মতো কেন!’

দুই ঠোঁট সামান্য প্রসারিত হলো এস ডি’র। কিন্তু একটু গভীরভাবে তাকালেই বোঝা যেত, ওই হাসিতে ক্লেদ আছে, তাচ্ছিল্য আছে, অবজ্ঞাও আছে, জীবনকে চরমভাবে উপেক্ষা করার এক শক্তি আছে।

‘আর কোনো ইচ্ছে?’

‘জি।’ সমাপ্ত-অসমাপ্তের মাঝামাঝিতে থেমে রইলেন এস ডি। একধরনের আড়ষ্টতা, কিছুটা দ্বিধাও দেখা গেল গলায়, সম্ভবত অবয়বেও। জড়বস্তুর মতো মেঝেতে পড়ে থাকা দেহটা তেমন নড়ে না উঠলেও একধরনের চঞ্চলতা দেখা গেল ভঙ্গিতে, ‘আমার পিঠটা আমি একটু দেখতে চাই।’

‘পিঠ দেখে কী হবে!’

‘দিয়োগো আলভেসকে অবশ্য আপনি চিনবেন না। কারণ, তিনি বাংলাদেশের কেউ নন, পর্তুগালের। এক সিরিয়াল খুনি তিনি, উনিশ শতকের। তার কাটা মাথাটি সংরক্ষিত আছে ইউনিভার্সিটি অব লিসবনে। মাথাটি রেখে দেওয়ার কারণ কী জানেন?’

‘কী?’

‘অপরাধীর মন নিয়ে গবেষণা করা।’ এস ডি হাসার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। তার দুই ঠোঁটের বাঁ পাশের সংযোগস্থলে রক্তের ধারাটি শুকিয়ে এলেও ক্ষতটা চকচক করছে এখনো। ভাগ্যিস, মাথা কিছুটা সরিয়ে নিতে পেরেছিলেন, না হলে মিলন সাহেবের উল্টো হাতের আংটিটা সরাসরি আঘাত করতে পারত তার চোখে।

‘আপনার পিঠের সঙ্গে ওই খুনির মাথার সম্পর্ক কী?’

‘রিমান্ডের চার দিন হলো আজ, সম্ভবত শেষ দিন। গত চার দিনে আমার পিঠে যে দাগগুলো পড়েছে, সেটা সংরক্ষণ করতে বলব আপনাদের। আমি মারা যাওয়ার পর চামড়াটা ছাড়িয়ে নেবেন। এখন অনেক প্রযুক্তি এসেছে মানুষের শরীর সংরক্ষণের। চামড়াটাও সংরক্ষণ করবেন। এরপর যারা যারা আসবেন—।’ এস ডি মাথা তুললেন, সামনের চেয়ারে বসা মিলন সাহেবকে দেখতে মেঝে থেকে যতটুকু উঁচু করা দরকার, করলেন, ‘মানে যাদের যাদের ধরে নিয়ে আসবেন, তাদের দেখাবেন, আশা রাখি তিন–চার দিন লাগবে না, এক বা দুই দিনেই রিমান্ড শেষ হয়ে যাবে। অবশ্য আমার মাথাটা, বিশেষ করে মাথার সামনের দিকটা, ঠোঁট-মুখ-কপাল-চোখ দুটো সংরক্ষণ করলে ভালো হতো। কিন্তু আমি তা চাচ্ছি না, এই না চাওয়ার বড় একটা কারণ আছে। তাই পিঠের চামড়াটার জন্য সুপারিশ করছি।’

‘মানুষটাকে মারলেন কেন আপনি?’ মিলন সাহেবের গলাটা এবার বেশ ঠান্ডা।

‘মারার কোনো রকম ইচ্ছে আমার ছিল না। প্রতি রাতে আমার মেয়েটা এত ডিস্ট্রার্ব করত, তাকে না মারার কোনো উপায় ছিল না।’ চেহারাটা কিছু কঠিন করে ফেললেন এস ডি, ‘মেয়েটা আমার মারা গিয়েছিল। মৃত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মানুষটাকে মেরেছি আমি, বলতে পারেন মারতে বাধ্য হয়েছি।’

‘তার মানে আপনার যে মেয়ে প্রতি রাতে আপনাকে ডিস্ট্রার্ব করত, সে মৃত ছিল!’

‘জি।’

‘একজন মৃত মানুষ আপনাকে ডিস্ট্রার্ব করত!’

‘জি।’

‘কীভাবে?’

মেরুদণ্ড সোজা করে বসার চেষ্টা করলেন এস ডি। পেছন দিকে বাঁধা হাত নিয়ে অনেকটা কুঁজো হয়ে বসেছিলেন এতক্ষণ। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ‘স্যার, একটা অনুরোধ করব?’

‘আজ আপনার সব অনুরোধ রক্ষা করা হবে।’ সিগারেটে আরও একটা টান দিলেন মিলন সাহেব, ‘বলুন।’

- Advertisement -

আরো পড়ুুর