মুহাম্মদ আবু আদিল, বিশেষ প্রতিনিধিঃ বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ বিভিন্ন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, যার মধ্যে কৃষি অন্যতম। বাংলাদেশের কৃষি খাতেও প্রযুক্তির প্রভাব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কেবল কৃষকের জীবনমান উন্নত করছে না, বরং এটি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
ডিজিটাল কৃষির নতুন দিগন্ত
বাংলাদেশের কৃষি এখন ডিজিটাল রূপান্তরের পথে। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে কৃষকরা ফসল ব্যবস্থাপনা, আবহাওয়া পূর্বাভাস, বাজারমূল্য ও রোগবালাই সংক্রান্ত তথ্য মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েব প্ল্যাটফর্ম থেকে সহজেই জানতে পারছেন।
বর্তমানে সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা “স্মার্ট কৃষি” বাস্তবায়নে কাজ করছে, যেখানে কৃষকেরা অনলাইনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারছেন, ফসলের সঠিক যত্ন সম্পর্কে জানতে পারছেন এবং কৃষি সরঞ্জাম ও বীজ অনলাইনে ক্রয় করতে পারছেন।
স্যাটেলাইট ও ড্রোন প্রযুক্তি: কৃষির স্মার্ট বিপ্লব
স্যাটেলাইট ইমেজিং ও ড্রোন প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া এনেছে। বর্তমানে ড্রোনের মাধ্যমে জমির উর্বরতা পর্যালোচনা, ফসলের রোগ শনাক্তকরণ, এবং কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। এটি সময় ও শ্রম সাশ্রয় করার পাশাপাশি উৎপাদন খরচও কমিয়ে দিচ্ছে।
ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে বড় আকারের কৃষি জমির ত্রিমাত্রিক চিত্র বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, যা কৃষকদের নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে। পাশাপাশি অটোমেটেড সেচ ব্যবস্থা ও মাটির গুণগত মান পর্যালোচনা প্রযুক্তি কৃষিতে আধুনিকতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
জৈব সার ও টেকসই কৃষি: পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ
বাংলাদেশে জৈব সারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি ফসলের গুণগত মান বৃদ্ধি করছে। বর্তমানে কৃষকেরা বায়োফার্টিলাইজার, কম্পোস্ট সার, এবং প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
তরুণদের উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও কৃষি স্টার্টআপ
বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তারা “কৃষি স্টার্টআপ” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রসারে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, “AgriTech”, “Smart Agro” এবং “iFarmer”-এর মতো স্টার্টআপগুলো অনলাইন কৃষি পরামর্শ, স্বয়ংক্রিয় সেচ ব্যবস্থা, এবং স্মার্ট ফার্মিং টেকনোলজি বিকাশ করছে।
এছাড়া, কৃষি রোবটিক্স ও এআই (Artificial Intelligence)-এর ব্যবহার বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন উদ্ভাবন চালু হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের কৃষি ব্যবস্থাপনাকে আরও দক্ষ করে তুলবে।
সরকারের উদ্যোগ ও নীতি সহায়তা
সরকার ডিজিটাল কৃষির প্রসারে বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে—
১. “কৃষি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম” তৈরি করা হয়েছে, যেখানে কৃষকরা কৃষি বিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ পাচ্ছেন।
২. “কৃষি কার্ড ও ডিজিটাল ঋণ সুবিধা” চালু করা হয়েছে, যা কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ নিতে সহায়তা করছে।
৩. ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস চালু করা হয়েছে, যেখানে কৃষকরা সরাসরি ক্রেতার কাছে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারছেন।
বাংলাদেশের ডিজিটাল কৃষির বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে “স্মার্ট এগ্রিকালচার” বা “ডিজিটাল কৃষি” বর্তমানে একটি বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
১. ৬০% এর বেশি কৃষক স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, যা ডিজিটাল কৃষি উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে।
২. কৃষি ডাটা বিশ্লেষণ ও এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষি উৎপাদনশীলতা ২৫-৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. অনলাইন মার্কেটপ্লেস ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
সামনের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যদিও বাংলাদেশে কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—
১. স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।
২. ছোট ও দরিদ্র কৃষকদের প্রযুক্তির আওতায় আনা।
৩. ডিজিটাল কৃষির জন্য প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন।
সরকার ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে কাজ করলে আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ আরও আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে।