গল্প:
ঠিকানা
জয়ন্ত বাগচী
স্টেশনে ট্রেনটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। ছাড়বে ছাড়বে করেও ছাড়ছে না। এমন সময় একজন হকারের মুখে শুনলাম গাড়ি ছাড়তে দেরী হবে সামনের একটা লেভেল ক্রসিং-এ এক্সিডেন্ট হয়েছে। কয়েকজন মারা গিয়েছে। মুহূর্তে খবরটা হাওয়ার বেগে কামরার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছড়িয়ে গেল দাবানলের মত! গুমোট গরমে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। অগত্যা স্টেশনে নেমে দাঁড়ালাম। বিশাল লম্বা স্টেশন। অণ্ডাল জংশন। স্টেশনের ওপরেই অনেক কৃষ্ণচূড়া গাছ। ফুলে ফুলে রঙের ছড়াছড়ি। প্রকৃতির বুকে যেন হোলির রঙ!
একজন চা বিক্রেতা কাছে এসে বলে, চা দেব নাকি বাবু?
– দাও, ট্রেন কখন ছাড়বে কিছু খবর পেলে?
– ছাড়তে দেরী হবে শুনছি। চা ঢালতে ঢালতে উত্তর দেয়।
মাটির ভাঁড়ে চা দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দেয়। গরম চা। হাতে গরম লাগতে একটু সামনে বসার বেদীটার দিকে এগিয়ে বসে পাশে ভাঁড়টা রাখি।
এই সময়টা এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক শোভা দেখার মত হয়। একটা সময় এই অঞ্চলে বেশ কিছুদিন ছিলাম। এখানকার প্রকৃতির সব কটা ছবিই আমার দেখা। বর্ষার বজ্রগর্ভ মেঘের গর্জন গ্রীষ্মের দারুণ দহন আর শীতের কাঁপিয়ে দেওয়া আবহাওয়া– সবকটার সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছে ইতিপূর্বে।
চা খেতে খেতে হঠাৎ চোখ পড়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলা এক মহিলার দিকে। চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে যায়। রীতা– রিতা সেন।
আমার অফিসের এ্যাকাউন্টট্যান্ট সৌগত আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
একদিন অফিসে সৌগতর ঘরে যেতেই কথাবার্তার মাঝে বলেছিল, দাদা এর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই।এর নাম রীতা সেন। বর্দ্ধমানে থাকে। তাছাড়া আপনিও তো বর্দ্ধমানের লোক।
মেয়েটি হাত তুলে বলে– নমস্কার। প্রতি নমস্কারের পর্বেই প্রশ্ন আসে– আপনি বর্দ্ধমানে থাকেন?
– না বর্দ্ধমানে দেশের বাড়ি। থাকি কলকাতায়।
সৌগত বলে– ও ইংলিশে এম এ করছে। বর্দ্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে। কিন্তু একটু সমস্যা হয়েছে। আসলে ওর বাবা নেই। বাড়ীতে শুধুমাত্র মা আছেন। বাবার পেনসনের টাকাটাই ওদের একমাত্র ইনকাম। তা এখন পরীক্ষার ফী জমা দিতে হবে… তাই…
বুঝতে অসুবিধা হয়না সৌগতর কথা। অর্থাৎ আমাকে কিছু আর্থিক সাহায্য করতে হবে। তখন বলি, ঠিক আছে, তোর কাছে সব শুনে নেব পরে। তুমি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হও। টাকার অভাবে পরীক্ষা দেওয়া হবে না এটা হয় নাকি!
সেই শুরু। তারপর থেকেই টুকটাক সাহায্য পর্ব চলতে থাকে। নিত্য নিত্যই নানা রকম সমস্যায় টাকা নিতে থাকে। তবে হ্যাঁ টাকা নেবার কিছুদিন পরেই এসে এ্যাডমিট কার্ড নিয়েছে তা দেখিয়েছিল।
একটা আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা। তাছাড়া কথাবার্তা বলতো খুব মার্জিত ভাবে। দিন চলছিল তার স্বাভাবিক গতিতেই।কিছুদিন পরেই সৌগতর মুখে শুনলাম ওর মা হাসপাতালে ভর্তি। সে পর্বেও কিছু টাকা দিছে হল।
কোলকাতা অফিস থেকে আমি বদলী হয়ে গেলাম মুর্শিদাবাদ জেলায়। ফলে সৌগত বা রীতার সঙ্গে যোগাযোগটাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
বেশ কয়েকমাস পরে হেড অফিসে এসে সৌগতর কাছ থেকে জানতে পারলাম রীতা একটা স্কুলে চাকরি করছে। সৌগত বলে, একদিন যাবেন নাকি ওদের বাড়ি?
আমি খুব একটা উৎসাহ দেখালাম না। সৌগত তবুও একটা কাগজে ঠিকানাটা লিখে দিল আমিও পকেটে রেখে দিলাম। ঠিকানাটা আমার মানি ব্যাগেই থেকে গিয়েছিল। অনেকদিন পর একবার দেশের বাড়ি গিয়ে মনে পড়ল রীতার কথা। ভাবলাম একবার ঘুরেই আসি! ব্যাগে ঠিকানাটা পেয়েও গেলাম। পরদিন সকালে বেড়িয়ে পড়লাম।
ঠিকানাটা খুঁজে পেতে বিশেষ দেরী হল না। কিন্তু ঐ নামের কাউকে সেখানে পেলাম না। আস-পাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে তারাও জানালো, এই নামে এখানে বিগত পনেরো বছরেও কেউ ছিল না। অবাক লাগলো। এও কি সম্ভব! কিন্তু এটাই বাস্তবে ঘটলো। ফিরে এলাম। একদিন ফোন করে সৌগতকে সব জানালাম। সেও অবাক হল। সে বললে, ঠিক আছে ব্যাপারটা জানতে হবে তো!
কিন্তু আর তেমন উৎসাহ পাইনি ব্যাপারটায়। ফলে সেটা অজানাই থেকে গিয়েছে। আজ এতদিন পড়ে হলেও রীতাকে বেশ চিনতে পারছি। আগের থেকে অনেকটাই স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে। পান্না সবুজ রঙের চুড়িদার পরেছে।ফর্সা চেহারায় সেটা বেশ আকর্ষনীয় লাগছে। সামনে একজন পুরুষ। পাশে একটা বেশ বড় ব্যাগ। সিঁদুর পরে আছে কিনা বুঝতে পারলাম না।
নিজের মনের মধ্যে সেই পুরনো দিনের কথাগুলো বেজে উঠতে লাগলো। আমি আজও বুঝতে পারলাম না ঠিকানাটা সে ভুল দিয়েছিল কেন? সৌগতকে ব্যাপারটা বলতেই সেদিন বলেছিল, দাদা ঠিকানাটা ও নিজেই ঐ কাগজটায় লিখে দিয়েছিল। আমি ভুল দিইনি! তাহলে?
আজ এতদিন পরে একজন মহিলাকে গিয়ে পুরনো দিনের কথার কৈফিয়ত চাইতে রুচিতে বাঁধলো।
স্টেশন চত্বরে যাত্রীদের হঠাৎ দৌড়দৌড়ি শুরু হল। বুঝলাম ট্রেন ছাড়বে। আমিও চায়ের ভাঁড়টা ডাস্টবিনে ফেলে এগিয়ে গেলাম নির্দিষ্ট কামরার দিকে।
দৈনিক অন্যধারা/১৭ জুন ২০২২/জ কা তা