অন্যধরা ডেস্ক
রেজাউদ্দিন স্টালিন একজন মানবিক কবি সমসাময়িক অন্যতম উজ্জ্বল মুখ। পরিশ্রমী এ কবি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পেরেছেন তার কবিতায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে তার কবিতায়। পাল্টেছে ফর্ম। তবে এ ফর্ম একই সময়ে বারবার তিনি ব্যবহার করেননি। বিভিন্ন ফর্মে উপস্থাপন করেছেন কবিতা। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, তার কোনো কবিতা উদ্দেশ্যহীন নয়। থাকে বক্তব্য।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের লেখার বিষয় অবারিত। কোনো গণ্ডিতে তিনি আবদ্ধ নন। দেশ সমাজ প্রকৃতি-তেমনি বাইরের পৃথিবীর কোনো বিষয় বাদ যায় না তার কবিতায়। বলা যায়, কবিতার সব শাখায় তার সমান বিচরণ।
কবি বাল্মীকি একটা তীরবিদ্ধ বক দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কবিতা বের হয়ে এসেছিল তার মুখ থেকে। আজও পৃথিবীতে ঘটে অসংখ্য ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো ঘটনা। বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য অনেক সমাজে বিরাজমান। আবার অনেকে সমাজের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়। সম্প্রতি এমন একটা ঘটনা মানব সমাজকে হতবিহ্বল করে দেয়। কবি তখন বলেন-
উইপোকার পেটে তলিয়ে যাচ্ছে শ্বাস বাক্স
ঈশ্বরের আসতে দেরি হবে
ফ্লয়েড তুমি যাত্রা শুরু করো
স্বর্গ দূরের পথ
রক্ত গড়ানো আকাশের ড্রেনে বুটের বুদ্বুদ
নীল ঘোড়ার হ্রেষা
নির্জনতা নেমে আসছে মেনিসোটায়
পৃথিবীর সব ২৫ মে শুয়ে আছে ফুটপাতের জিহ্বায়
(আত্মার ইতিহাস)
গ্রিক, রোমান, মিশরীয়, আরবীয় ও ভারতীয় মিথ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন কবি। মিথের প্রতি দুর্বলতা সব কবি ও গল্পকারের ভেতর দেখা যায়। মিথ শুধুমাত্র পৌরাণিক কাহিনী নয়। মিথে আছে যেমন যুদ্ধ ও ক্ষমতার লড়াই, তেমনি আছে ভালোবাসা ও মানবিকতা। হোমারের মতো চারণ কবিদের কাছে তা সাহিত্য হয়েছে উঠেছে। মিথ যেন মানুষের জীবনেরই কথা, বর্ণনা পেয়েছে রূপকথার আদলে। স্টালিনের অনেক কবিতায় এসেছে মিথ। ব্যবহার করেছেন যথার্থভাবে, যা কবিতার বক্তব্যকে দৃঢ় করেছে। কোনো কোনো কবিতা তিনি গ্রিক, রোমান, ভারতীয় ও অন্যান্য মিথ একসঙ্গে গেঁথেছেন কবিতায়। তাতে কবিতা আরও বেশি অর্থময় হয়ে উঠেছেÑ
জীবনের নিজস্ব নদী আছে
বালি ও শামুক
প্রতিটি ঢেউয়ের বাঁকে ভাঙনের স্বর
তাকে চিনি প্রথা ছেঁড়া আগুনের পাখি
প্রবাল দুঃখ থেকে জেগে ওঠা দারুচিনি দ্বীপ
সর্বনাশ চোখে নিয়ে বসে থাকা দগ্ধ একিলিস
(দগ্ধ একিলিস)
তার কবিতা সব ধরনের পাঠকের জন্য। আবার যে পাঠক গভীরে যেতে চান তার জন্যও রয়েছে পড়াশোনা ও অনুসন্ধানের অবকাশ। কবিতার সঙ্গে তারও পড়া হয়ে যাবে ইতিহাস ও বিভিন্ন মিথ। ‘কতদূর ইথাকা’ কবিতায় তিনি বলেন-
অনেকদূর হেঁটে এসে পেছনে তাকালে
আর বাড়ি দেখা যায় না
দৃষ্টির সূর্যপথ উঠে যায় মেঘবৃক্ষে
পেছনে কার বাড়ি
চণ্ডীদাসের নাকি কাহ্নপার
জ্ঞানদাস একবার বিদ্যাপতির নিমন্ত্রণে এসে
পথ হারিয়ে বহুদিন আলাউলের অতিথি ছিলেন
আর কালিদাসের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও
যেতে পারেননি মোহাম্মাদ সগীর।
বিজ্ঞান জানলে কবিতায় বৈচিত্র্য আনা যায়। আবার ইতিহাস চর্চা যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন নতুন তথ্যে নিজেকে পূর্ণ করা। ইতিহাস সচেতন কবি লিখেন-
এক নাইটিংগেল
বুকের রক্তে ফুটিয়েছি রক্তের নীল গোলাপ
আমি জ্বলছি জন্ম আমি মাতাহারি থেকে
তবু পরাজিত হইনি কখনো
এমনকি এই পাতানো মৃত্যুমঞ্চেও না
বরং বিচারের পরাকাষ্ঠায় দাঁড়িয়ে
হেসে উঠছি হা হা-পৃথিবী দেখুক
নগ্ন আদিম স্তনের অন্ধকারে
উদ্ধত নিরাপোষ এক নারী
মাতাহারি
(আমি মাতাহারি)
তার কবিতায় আছে গভীর জীবনবোধ। এ জীবনবোধ তাকে একাত্ম করেছে পাঠকের সঙ্গে। কবির ভায়ায়-
এতো হত্যা দুঃখদাগ
জন্ম তবে কেন দরকারি,
কারো কর্ম দায়ভাগ
নেবেন কি উত্তরাধিকারী?
জীবিত জিজ্ঞেস করে
মৃত্যুর পরের সরণি,
আর জানলে কী করে তুমি এখনো মরোনি?
(গোপনীয়তা)
মানব জীবনের প্রেম, স্বপ্ন, আশা, সুখ-দুঃখ তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন তার কবিতায়। কবি লিখেছেন-
জীবন এক পুড়ে যাওয়া প্রতিবিম্ব
আর মৃত্যু চা-পাতার ঘোড়া
টগবগ করছে দরোজার ডেকচিতে
প্রেমণ্ডএক প্রযুক্তি যা উৎপাদন করে অদৃশ্য জানালা
স্মৃতি-অদ্ভুত পাঠাগার যার বই পড়ে দীর্ঘশ্বাস
স্বপ্ন-ফেলে আসা জাদুঘর যেখানে
হাওয়ার হামলায় লুকিয়ে থাকে বর্ষাতি
আশারা-ময়ূর পালকে স্থাপিত
আর্গাসের শত শত-চোখ
এই কবিকে অভিনন্দন।
অন্যধারা//এমকেএ