মোঃ ফোরকান উদ্দিন:
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত-এ কথাটি বাংলাদেশসহ সারা
বিশ্বে স্বীকৃত। অনেক সময় অন্যান্য অনেক প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয়
বিষয়ের চাপে শিশুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার বিনোদনের ব্যাপারটি
প্রায় উপেক্ষিত থাকছে। শহরজুড়ে শিশুদের পোশাক, খেলনার দোকান, পার্ক,
স্কুল, গাননাচ শেখার কোচিং থাকলেও প্রকৃত বিনোদনের ব্যবস্থা নেই।
শিশুর বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে খেলাধূলা। কিন্তু খেলার মাঠ বা
বাড়ির সামনের উঠানের দেখা মেলে না সহজে। গ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে
মাঠ থাকলেও শহরে তেমন দেখা যায় না। আবার যেখানে মাঠ আছে সেখানেও
অনেক ক্ষেত্রে খেলাধূলার সুযোগ নেই শিশুদের।
স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বাজলেই তাদের দৌড়াতে হয় কোচিং বা প্রাইভেট
টিউটরের কাছে। বইয়ের ভারে ক্লান্ত শিশুরা সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। এত কিছুর
মাঝে খেলার সময় আর হয় না। তাই বিনোদনের জন্য শিশুদেরও খুঁজতে হচ্ছে
অন্যকিছু।
সচ্ছল পরিবারগুলো সন্তানদের আগ্রহী করছে কম্পিউটার গেমসের প্রতি।
অন্যদেরও বিনোদনের একমাত্র উপায় টেলিভিশন। শিশুরা সুস্থ বিনোদনের
জগৎ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কারণ শিশুতোষ কোন টেলিভিশন চ্যানেল
এখানে নেই। শিশুরা কার্টুনের জন্য ঝুঁকছে ভিনদেশি চ্যানেলের প্রতি। এতে
শিশুদের দেশি সংস্কৃতির সঙ্গে দূরত্ব তৈরির পাশাপাশি অপসংস্কৃতির
আগ্রাসন বাড়ছে। ফলে শিশুদের মাঝে সামাজিক মূল্যবোধের ব্যাপক ঘাটতি
তৈরি হচ্ছে।
উদ্ভূত এ বিপজ্জনক পরিস্থিতির প্রতিকার জরুরি। দুঃখজনক হলেও সত্যি
বাংলাদেশে এখনো খুব বেশি কার্টুন সিরিজ তৈরি হয়নি। ইউনিসেফের মীনা
কার্টুনটি এক সময় শিশুদের মাঝে খুব জনপ্রিয় ছিল। এখন সেটাও আর নতুন
করে তৈরি করা হচ্ছে না।
এভাবে প্রতিটি মুহূর্তে শিশুর জীবনে অদৃশ্য ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে, যা তার
জীবনযাপনে স্বাভাবিকের চেয়ে ভিন্ন ধরনের প্রভাব ফেলে। সহজ-সরল
জীবনযাপনে বাধার সৃষ্টি করে। আসক্তি যেকোনো কিছুর জন্যই বিপদ ডেকে
আনে। এমনকি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা শুধু যে সময়ের ক্ষতি করে তা নয়,
শারীরিক এমনকি মানসিক সঙ্কটও দানা বাঁধে শিশুর মস্তিষ্কে।
প্রত্যক্ষভাবে তাই অনেককে স্বাভাবিক মনে হলেও, মানসিকভাবে
অসুস্থতার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনের জন্য
শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকা খুব বেশি জরুরি। একটি আরেকটির
পরিপূরক।
শিশুর বিকাশ বলতে জন্ম থেকে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে বৃদ্ধি
ও পরিপক্কতার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। যেহেতু শিশুরা বছরের পর বছর বড়
হয় সেহেতু, এটি শারীরিক, জ্ঞানীয়, মানসিক এবং সামাজিক দিকগুলিসহ
বিভিন্ন ডোমেনে ঘটে যাওয়া ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনগুলিকে অন্তর্ভুক্ত
করে। জেনেটিক্স, পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতা- এ তিনটি ক্ষেত্র শিশুদের
সক্ষমতা, দক্ষতা এবং আচরণ গঠনের জন্য একত্রে কাজ করে। শিশু তার
শৈশবকালে যে পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে পারে, তাতে স্কুল
এবং তাদের শিক্ষকমন্ডলী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিশুদের সামগ্রিক বিকাশে স্কুল একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং একটি
কাঠামোগত পরিবেশ প্রদান করে, যা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক,
মানসিক এবং শারীরিক বৃদ্ধিকে লালন করে। স্কুল তাদেরকে ভবিষ্যতের
জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জ্ঞান দিয়ে সজ্জিত করে। প্রতিটি শিশু
স্কুলে যে অভিজ্ঞতাগুলির চর্চা করে তাতে তাদের সামগ্রিক বিকাশলাভ
সুন্দর হয়।
এ ক্ষেত্রে স্কুল একটি কাঠামোগত এবং সংগঠিত শিক্ষার পরিবেশের সাথে
বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে উৎসাহিত করে, যেখানে শিশুরা জ্ঞান অর্জন
করতে পারে, জ্ঞানীয় দক্ষতা বিকাশ করতে পারে এবং তাদের একাডেমিক
কর্মক্ষমতা বাড়াতে পারে। শিক্ষকরা কার্যকর নির্দেশনা প্রদান করে
শেখার অভিজ্ঞতা সহজতর করে এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে
স্বতন্ত্র সহায়তা প্রদান করে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
থাকেন। বিশেষত, স্কুলগুলি একটি পরিপাটি পাঠ্যক্রম, সিলেবাস এবং
মূল্যায়ন পদ্ধতি অফার করে, যা শিশুদের একাডেমিকভাবে উন্নতি করতে
এবং ভবিষ্যতের শিক্ষাগত সাধনার জন্য প্রস্তুত করতে সহায়তা করে।
বহুভাষিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে, শিশুরা ছোটবেলা থেকেই একাধিক ভাষার
সংস্পর্শে আসে, যা ভাষা অর্জন এবং দক্ষতাকে উন্নীত করে।
শিশুদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে স্কুলগুলির একটি উল্লেখযোগ্য
প্রভাব রয়েছে। তারা বিভিন্ন মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি শেখার
এবং বোঝার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে। ক্রিয়াকলাপভিত্তিক
শিক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এনে এবং সহানুভূতিপূর্ণ
অনুভূতি জাগিয়ে তুলে, স্কুলগুলি শিশুদের একটি শক্তিশালী নৈতিক কম্পাস,
অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য উপলব্ধি গড়ে
তুলতে সাহায্য করে। স্কুলগুলি শিশুদেরকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির
পাশাপাশি অন্যদের সংস্কৃতি সম্পর্কে শেখার সুযোগও করে দেয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদযাপন করে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ
গড়ে তোলার মাধ্যমে, স্কুলগুলি সাংস্কৃতিক সচেতনতা, সম্মানবোধ এবং
অন্যের উপলব্ধি বোঝার সক্ষমতা তৈরি করে। বিভিন্ন পটভূমির
সহকর্মীদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করার মাধ্যমে শিশুরা একটি বিস্তৃত
দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে, আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের দক্ষতা বিকাশ
করে এবং আরও খোলা মনের হয়ে বেড়ে ওঠে।
এ যুগে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার স্কুলের নিত্য-নৈমিত্তিক
কার্যক্রমের অংশ। শিশুরা তাদের শৈশব শিক্ষার মাধ্যমে অতি অল্প বয়স
থেকেই উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে পারে। রোবটিক্স, কোডিং,
ইন্টারনেট ব্রাউজিং, গেমিং এবং অনলাইন শিক্ষার অধিকাংশ উপকরণের
সাথে পরিচিতি লাভ করে। শৈশবকাল থেকে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির
সংস্পর্শ শিশুদের মাঝে একটি বিশেষ অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে এবং তাদের
মধ্যে একটি উদ্ভাবনী শক্তির উদ্রেক হয়। ফলে তারা যেকোন
প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহনের সাহস সঞ্চার করতে
পারে। বর্তমানে বহুল আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিসিয়াল
ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহারের মাধ্যমে স্কুলগুলি শিশুদেরকে আধুনিক
প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞানলাভ করতে সাহায্য করে।
যেহেতু আমি একজন আইন জগতের নগণ্য ছাত্র সেহেতু এই জায়গা থেকে
কিছু না লিখলেই নয়। শিশুর বিকাশে পরিবার প্রথম ও শক্তিশালী
প্রতিষ্ঠান। পরিবারের পরই সমাজ গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা
রাখে। একটি শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই শিশুর
পারিবারিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী শিশুদের
অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক
সম্মেলনের মাধ্যমে ‘শিশু অধিকার ঘোষণা করা হয়। শিশু অধিকার সনদ
অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া
হয়েছে। শিশু অধিকার সনদে ৫৪টি ধারা এবং ১৩৭টি উপ-ধারা রয়েছে। এই
উপ-ধারাগুলোতে শিশুদের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের বৈষম্য থেকে বিরত
থাকা, শিশুদের বেঁচে থাকা ও বিকাশের অধিকার, নির্যাতন ও শোষণ থেকে
নিরাপদ থাকার অধিকার, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে
পুরোপুরি অংশগ্রহণের অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো
বিষয়গুলো বর্ণিত রয়েছে। সনদে বর্ণিত প্রতিটি অধিকার প্রত্যেক শিশুর
মর্যাদা ও সুষম বিকাশের জন্য অপরিহার্য। স্বাস্থ্য পরিচর্যা, শিক্ষা ও
আইনগত, নাগরিক ও সামাজিক সেবা প্রদানের মান নির্ধারণের মাধ্যমে এ
সনদ শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ করে থাকে। শিশু অধিকার সনদে
স্বাক্ষরকারী দেশগুলো শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ বিবেচনা করে যাবতীয়
নীতি প্রণয়ন ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে দায়বদ্ধ।
শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ বলতে মা-বাবা, সংসদ, আদালত এবং সংশ্লিষ্ট
কর্তৃপক্ষ অবশ্যই শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থে কাজ করবেন এ বিষয়টিকে
বোঝানো হয়েছে।
শিশুর অধিকার সমুন্নত রাখা পিতামাতার দায়িত্ব। এটি বলতে সনদে বর্ণিত
অধিকারসমূহ প্রয়োগের ক্ষেত্রে মা-বাবার একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে
বিষয়টি বোঝার।
শিশুর মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আওতায় নিজের মতামত গঠনের
উপযোগী বয়সের শিশুর নিজস্ব বিষয়ে অবাধে মতপ্রকাশের অধিকারকে
বোঝানো হয়েছে। ‘এমন একদিন আসবে যখন সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তি
দেখে একটি দেশকে বিচার করা হবে না, বরং অসহায় অবস্থায় পতিত
শিশুদের মানসিক ও দৈহিক বিকাশের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
হয়েছে, সেই নিরিখেই দেশটিকে বিচার করা হবে।
সর্বোপরি আমি বলবো, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে
হলে, পরিবার, সমাজ, এবং রাষ্ট্রের একসাথে কাজ করা প্রয়োজন। শিশুর
মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে, তাদের বিনোদনের
সুযোগ বৃদ্ধি এবং একটি সুরক্ষিত ও প্রেরণাদায়ক পরিবেশ তৈরি করা
জরুরি।
লেখক: মোঃ ফোরকান উদ্দিন, আইনের শিক্ষার্থী।
দৈনিক অন্যধারা/ ২৯ জুন ২০২৪